‘আমার বোনের বিচার চাই’ – তিলোত্তমার বিচার চেয়ে আন্দোলনের শরিক মাটিকুমড়ার উমারাও

Published On:
লেটেস্ট আপডেট সবার আগে Join Now

🖋️কনিনীকা মজুমদার ও দেবব্রত মণ্ডল: শিয়ালদা স্টেশনে (Sealdha Station) এসে রানাঘাট লোকালটা যখন ধরলাম তখন আকাশ কালো করে রীতিমত ঝেঁপে বৃষ্টি এসেছে। এসব দিনে বাইরের অ্যাসাইমেন্টে যেতে মন চায় না। কিন্তু উপায় নেই, চাকরি বিষম বস্তু। ঢিমেতালে চলতে শুরু করল ট্রেন। জানালায় চোখ রেখে বাইরে তাকাতেই চোখে যেন আরাম হল। শহরের ব্যস্ততা, কোলাহল পেরিয়ে এই সবুজের মাঝেই যেন দুদণ্ড শান্তি। এসব বৃষ্টিভেজা দিনে এই স্বল্প দূরত্বের ট্রেনজার্নিগুলো যেন ফিরিয়ে আনে হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলাকে – মনে পড়ে ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবির সেই গানটা। ‘মেঘ পালাচ্ছে রোদ পালাচ্ছে, এখন বেগনি বেলা। কু ঝিক ঝিক , কু ঝিক ঝিক পালাচ্ছে ছেলেবেলা।’ এখন এই দশটা – পাঁচটার কর্মব্যস্ত জীবনে সেসব বৃষ্টিভেজা ছেলেবেলা যেন কতদূরে।

আরও পড়ুনঃ মোদী-যোগীর প্রশংসা মুসলিম বধূর, ‘তালাক’ দিলেন স্বামী

আজ অবশ্য আমাদের গন্তব্য খুব বেশি দূরে নয়। রাণাঘাট স্টেশন থেকে আরও ২৫-৩০ মিনিট বা বড়জোর মিনিট ৪০ এগোলেই আপনি পৌঁছে যাবেন এই গ্রামে। এমন বৃষ্টির দিনে পায়ে কাদা মেখে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতে কার ভাল লাগে বলুন? কিন্তু ওই যে ঘুরতে পারব না বললে তো চলবে না। এটাই যে তোমার অন্ন সংস্থান করে বাপু। তা হঠাৎ এই গ্রামে আসার অবশ্য একটা কারণ আছে। সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য।

যতক্ষণে মাটিকুমড়া গ্রামে এসে পৌঁছান গেল ততক্ষণে বৃষ্টিও আমাদের পিছনে পিছনে এসে হাজির। পৌঁছতে না পৌঁছতেই ধারাস্নান করিয়ে দিল আমাদের। স্থানীয় একজনকে জিজ্ঞেস করতে সেই বলে দিল এখানেই নাকি আয়োজন হয়েছে সেই বিরাট কর্মযজ্ঞের। অথচ দেখে কিন্তু তেমন কিছু মনে হল না। আশেপাশে দু – একটা দোকানপাট। সেগুলোতে অবশ্য দু – একজন করে মানুষের ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। গ্রামের প্রায় প্রত্যেকটা মানুষের এই এক অভ্যাস। ঠিক সন্ধ্যা নামার মুখে চা – বিড়ি আর অবিরাম আড্ডা না হলে তাদের দুপুরের ভাত হজম হয় না। এমনিতে শান্ত – নিস্তরঙ্গ জীবন। অথচ ওই আড্ডাগুলোতে ঢুঁ মেরে দেখুন মোদি থেকে রাহুল তো বটেই এন ডি এ টু ইন্ডিয়া সব খবর পাবেন। এক কাপ চা নিয়ে সবে দু – এক চুমুক দিয়েছি। এমন সময় স্লোগান উঠল – ‘আমার বোনের বিচার চাই।’

আজ ১৫ দিন, এখনও মেলেনি তিলোত্তমার নৃশংস হত্যার বিচার। চারিদিকে সবার মুখে খালি একটাই স্লোগান ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস!’ কিন্তু জাস্টিস কি আদৌ মিলবে? মানুষের ক্ষোভ এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে এই লড়াই। শহরতলি থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম সবেতেই এখন একটাই স্বর- আর জি করের ন্যায়বিচার চাই। তা সে কলেজ স্ট্রিটের পথের প্রতিবাদী গ্রাফিতি হোক কিংবা বিভেদ ভুলে মাঠে নেমে ঘটি-বাঙালদের লড়াই। স্লোগান তুলে প্রতিবাদ হোক কিংবা মোমবাতির আলোয় নিজেদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। দেওয়ালে পিঠ থেকে যাওয়ার পরবর্তী সময়ে আর হয়তো কিছু করার থাকে না, তাই হয়তো আজ রাস্তায় রাস্তায় সেই প্রত্যেকটা পিঠ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কখনও কলকাতার ভেজা রাজপথ, কখনও টাইম স্কোয়ারের ভিড়, আবার কখনও বা মাটিকুমড়ার এঁদো মাঠ পেরিয়ে চলেছে এই প্রতিবাদ। সত্যি, কেউ আর থেমে নেই।

এই যে আন্দোলন, এর সার্থকতা কোথায় জানেন? যে আন্দোলন শুরু করেছিল সাধারণ কিছু ছাত্র, সেই আন্দোলনই পরিণত হয়েছে গনআন্দোলনে। গ্রামের মানুষও আজ এই প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন, পায়ে পা মিলিয়েছেন। কলকাতার রাজপথে যখন হাজার হাজার সাধারণ মানুষ স্লোগান তুলছেন তিলোত্তমার বিচারের দাবিতে তখন মাটিকুমড়ার সাধারণ জনগণের আর্জি ‘আরজি’ করের জন্য। একটা মেয়ে মরে গিয়েও মিলিয়ে দিয়ে গেছে গ্রাম আর শহরকে, মিলিয়ে দিয়ে গেছে ডান-বাম সব পক্ষকে।

আরও পড়ুনঃ পকেটমানিতেই 5G Smartphone, দারুণ সুযোগ

‘আমার বোনের বিচার চাই।’ সত্যিই তো, এই মুহূর্তে বিচারটুকুই তো শেষ সম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিলোত্তমার বিচার কি আদৌ মিলবে? বিচার চায় এখন প্রতিটা সাধারণ মেয়ে। শহরের যে মেয়েটা রাতে বাড়ি ফেরার সময় ক্যাব চালকের অসভ্যতার সাক্ষী থাকে এই আন্দোলন যেমন তার তেমনই গ্রামের যে মেয়েটা সংসারসীমান্তে প্রতিনিয়ত লড়ে যায়, আন্দোলনটা তারও। এখন কিন্তু কিন্তু শুধু খুন আর ধর্ষণের মধ্যে আবদ্ধ নেই এই ঘটনা। এখন আন্দোলন চলছে মেয়েদের অধিকার আদায়ের দাবিকে সামনে রেখে। মেয়েরা কি সত্যিই সুরক্ষিত? চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন তুলছেন নারীরাই। মাটিকুমড়ার টুম্পা, বৃষ্টিদের মতো অনেকেরই চোখে একটাই প্রশ্ন। ওদের সামনে এমন কোন ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করে নেই তো? আদতে নিখাদ গ্রাম মাটিকুমড়া, যেখানে এখনও অনেক মেয়ের সম্বল লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। কন্যাশ্রী না পেলে যেখানে পড়াশোনার খরচ মেলা দুষ্কর সেই গ্রামেরই প্রায় বহু মহিলা আজ উপস্থিত ছিলেন আজকের মিছিলে। তাঁদের প্রত্যেকের মুখে খালি একটাই প্রশ্ন, ‘আমার মেয়ে সুরক্ষিত তো?’ ‘বোনকে একা পড়তে পাঠাই, চিন্তা হয়।’

তিলোত্তমার বিচার চেয়ে রাত জাগছে গোটা দেশ। বিচারের দাবিতে সোচ্চার কলকাতা। গানে, স্লোগানে, মিছিলে সেখানে মধ্যরাতে অসংখ্য পা বদল করছে ফুটপাথ। পিছিয়ে নেই মাটিকুমড়া, পিছিয়ে নেই এখানকার মেয়েরাও। তাদের গলাতেও একটাই স্বর – ‘ উই ওয়ান্ট জাস্টিস।’ প্রশ্ন একটাই কবে বিচার পাবে তিলোত্তমা?