দেবব্রত মণ্ডল: একদিকে তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যদিকে দীর্ঘদিনের পোড়খাওয়া রাজনীতিক বিজেপি প্রার্থী অভিজিৎ দাস, এই পরিস্থিতিতে কতটা লড়াই দেবেন সিপিএমের তরুণ তুর্কী প্রতীকউর? লোকসভা ভোটের আগে এই প্রশ্নটাই বড় হয়ে উঠেছে সমগ্র ডায়মন্ড হারবার জুড়ে। এক অর্থে প্রতীকউর ডায়মন্ড হারবারের ঘরের ছেলে। ফকিরচাঁদ কলেজে তার পড়াশোনা, সেই সময় থেকেই ছাত্র – রাজনীতিতে হাতেখড়ি। সালটা ২০১০, তৃণমূলের হাতে আক্রান্ত হন প্রতীকউর। তারপর গঙ্গা দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল, কেটে গেছে চোদ্দটা বছর। যত দিন গেছে ততই রাজনীতিতে নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করেছেন প্রতীকউর। গায়ে মফঃস্বলের গন্ধ মেখে, মেঠো ভাষায় বক্তৃতা আর লাল ঝান্ডার স্বপ্নকে পাথেয় করে প্রতিপক্ষকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছেন, পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছেন সিপিএমের অন্দরে।
গত বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএমের ‘শূন্য’ ফলের মধ্যেও আশা জাগিয়েছিলেন প্রতীকউর। তিনি পেয়েছিলেন ১৭.১৮ শতাংশ ভোট। এহেন তাকেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে প্রার্থী হিসেবে বেছে নিয়েছে সিপিএম। লোকসভা নির্বাচনের আগে প্রতীকউরের হাতে কিন্তু ইস্যুর অভাব নেই। নিয়োগ দুর্নীতিকান্ডে বেশকিছুটা ব্যাকফুটে রাজ্যের শাসক দল। তার সঙ্গে আছে সন্দেশখালি, রেশন দুর্নীতি, কয়লা দুর্নীতির মতো ইস্যু। প্রতীকউর কিন্তু এসবের থেকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন মানুষের ‘রোটি – কাপড়া- মকান’- এর দাবিকে। সারাদিনের নির্বাচনী প্রচার, দৌড়ঝাঁপ শেষেও প্রতীকউরের গলায় ক্লান্তির লেশমাত্র নেই। তিনি বললেন, ‘ভোটটা হওয়া উচিত মানুষের রোটি, কাপড়া, মকানের দাবিকে সামনে রেখে। সাধারণ মানুষের দু-মুঠো ভাত, ডালের আর মাথার উপর ছাদের ব্যবস্থা করতে পারলেই কিন্তু অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। ডায়মন্ড হারবারের বুকে ছোট থেকে বড় হয়ে উঠেছেন প্রতীকউর। ঘরের ছেলের লড়াইটা কতটা কঠিন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে? প্রতীকউরের উত্তর – ‘আমার লড়াই কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, তৃণমূল আর বিজেপির জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে।
লোকসভা ভোটের আগে কেমন আছে ডায়মন্ড হারবার? কান পাতলেই কিন্তু শোনা যাচ্ছে ক্ষোভের সুর। নীলিমা বিশ্বাস, অসীম হালদাররা ক্ষোভের সঙ্গেই জানালেন গতবার তারা ভোটই দিতে পারেননি। একই সুর প্রতীকউরের গলাতেও। তিনি বললেন, ‘ জানেন গত দশ বছরে মানুষকে ভোট দিতে দেওয়া হয়নি। মানুষ নিজের ভোট নিজে দিতে পারলে ফলাফল হয়তো অন্যরকম হতো।’ কয়েকদিন আগে বজবজ, ফলতা, মহেশতলার মতো এলাকায় চাবির গোছা নিয়ে ঘুরেছিলেন প্রতীকউর, কারখানা বন্ধের প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি। এদিন ক্ষোভের সুরে তিনি বললেন, ‘রাজ্যে বছর বছর টাকা খরচ করে বাণিজ্য সম্মেলন হচ্ছে অথচ একটার পর একটা কারখানার গেটে তালা ঝুলছে।’ প্রতীকউর প্রশ্ন তোলেন, ‘এই এলাকার বহু মানুষ দর্জির কাজ করেন। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সংসদে কতদিন তাদের সুযোগ – সুবিধা নিয়ে সরব হয়েছেন?’
আরও পড়ুনঃ ভোটে আবহে আয়করের হানায় উদ্ধার টাকার পাহাড়
প্রতীকউর খুব কাছ থেকে দেখেছেন মীনাক্ষী মুখার্জীকে। বিরোধী নেত্রী হিসেবে কে এগিয়ে? মীনাক্ষী না মমতা? উত্তরে সিপিএম প্রার্থী বললেন, ‘বিরোধী নেত্রী থাকার সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিঃসন্দেহে লড়াই করেছেন। কিন্তু তারপরেও আমি এগিয়ে রাখবো মীনাক্ষীকে। কারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বিরোধী নেত্রী ছিলেন রাজ্যের মসনদে তখন বাম সরকার। সেই কারণেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিনা বাধায় দিনের পর দিন ন্যাশনাল হাইওয়ে অবরোধ করে বসেছিলেন। কারণ বাম সরকার মনে করত, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন সবাই করতে পারে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অনেক কঠিন। মীনাক্ষীরা সেই পরিস্থিতিতেও লড়াই করছেন।’ রাজ্যে লোকসভা ভোটের দামামা বেজেছে, অথচ বুদ্ধবাবু সেখানে একেবারে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বেন তা কীভাবে হয়? সুতরাং অবশ্যম্ভাবী বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি। কয়েকদিন আগেই বুদ্ধবাবুর একটি এআই ভিডিও প্রকাশ করা হয় সিপিএমের তরফে। যেখানে দলের হয়ে ভোট চাইছিলেন বুদ্ধবাবু। প্রশ্ন ওঠে দল এখনও কেন বুদ্ধবাবুর মুখাপেক্ষী? তাহলে কি দলে যোগ্য নেতৃত্বের অভাব? প্রতীকউর অবশ্য মানতে রাজি নন। তিনি বললেন, ‘ জনমানসে বুদ্ধবাবুর গ্রহণযোগ্যতাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। প্রচারের ক্ষেত্রে তার সেই ভাবমূর্তিকে কাজে লাগাবার চেষ্টা করছে দল। আমাদের দলের প্রত্যেক একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে, আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার ছাপ রাখে। ফলে আমাদের দলে কোনদিন নেতার অভাব হয় না। বামপন্থীরা নতুনকে স্বাগত জানাতে জানে, তাই উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে এই ভিডিও তৈরি করা হয়েছে। অথচ আপনারা বলেছিলেন আমরা কম্পিউটার আনতে বাধা দিয়েছি। কিন্তু এই বামেরাই সেক্টর ফাইভ তৈরি করে গেছে। যার জন্য হাজার হাজার ছেলেমেয়ের কর্মসংস্থান হয়েছে। শেষবেলায় বাম সৈনিকের গলায় কি অভিমানের সুর?
বেলাশেষের সূর্য অস্ত যাচ্ছে পশ্চিম আকাশে। ডায়মন্ড হারবারের আকাশে ভিড় করেছে ঘরে ফেরা পাখির দল। প্রতীকউর উঠলেন, এখনও অনেক লড়াই বাকি যে। বিকেলের সেই মনখারাপ করা আলোয় তখনও জ্বলজ্বল করছে লালপতাকা।