Pathra Temple Town: সমগ্র পশ্চিম মেদিনীপুর (Paschim Midnapore) জেলা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য এমন পর্যটন স্থান (Midnapore Tourist Spot) যেগুলো বাস্তবে পর্যটকদের কাছে ব্রাত্য। নেই ঠিকঠাক যোগাযোগ ব্যবস্থা, নেই পর্যটকদের থাকার জায়গা, সঙ্গে রয়েছে সঠিক প্রচারের অভাব। তেমনই এক উদাহরণ হল, মেদিনীপুরের বিস্মৃত মন্দির সমৃদ্ধ গ্রাম (Temple Town) পাথরা (Pathra)। মেদিনীপুর (Midnapore) সদর ব্লকের এই গ্রাম (Pathra) জুড়ে রয়েছে অনেকগুলি মন্দির। যার অধিকাংশ পুরাতাত্ত্বিক বিভাগ কর্তৃক সংরক্ষিত। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের পর্যটনপ্রেমী মানুষদের কাছে আজও অজ্ঞাত পাথরা।
আমাদের রাজ্যে মন্দিরের জন্য অন্যতম বিখ্যাত বর্ধমানের অম্বিকা কালনা ও বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর। কিন্তু পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা শহর মেদিনীপুরের খুব কাছেই রয়েছে এমন আরেকটি মন্দির গ্রাম, পাথরা। মেদিনীপুর শহর থেকে প্রায় পনেরো কিলোমিটার পশ্চিমে, কংসাবতী নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত পাথরায় রয়েছে ৩৪টি মন্দির, যার মধ্যে ২৮ টি ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক সংরক্ষিত। ভগ্নপ্রায় মন্দিরগুলির মধ্যে ১৮টি-কে আইআইটি খড়গপুরের স্থাপত্য বিভাগের কারিগরি সহায়তায় মেরামত করা হয়েছে। পাথরার বেশিরভাগ মন্দির নির্মাণ করেছে ঘোষাল পরিবার। তাঁদের পূর্বপুরুষ বৈদ্যনন্দ ঘোষাল বাংলার নবাব আলীবর্দী খানের অধীনে রত্নচক পরগণার কর আদায়কারী হিসাবে কাজ করেছিলেন (১৭৪০ – ৫৬)।
Pathra Temple Town
এই বৈদ্যনন্দ ঘোষাল পাথরায় বেশ কিছু মন্দির নির্মাণ করেন। কিন্তু রুষ্ট হয়ে ওঠেন নবাব আলীবর্দী। তাঁকে হাতির সম্মুখে ফেলে পিষে মারার দন্ড দেওয়া হয়। কথিত আছে, হাতিটি বৈদ্যনন্দকে পিষে হত্যা করেনি। এই ঘটনাটিকে অলৌকিক হিসাবে ভেবে নিয়ে তাঁকে মুক্ত করেন নবাব। এরপর আরও বেশ কিছু মন্দির নির্মাণ করেন বৈদ্যনন্দ। সেই সঙ্গে স্থানটি পাথরা (পা = (হাতির) পা, উথরা = পলায়ন) নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে ঘোষালরা মজুমদার উপাধি গ্রহণ করেন এবং মন্দির নির্মাণ অব্যাহত রাখেন। পাথরার বন্দোপাধ্যায় পরিবারও বেশ কিছু মন্দির তৈরি করে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত পাথরার মন্দিরগুলি নির্মিত হয়েছে।
পাথরা
পোড়ামাটির টেরাকোটা ও চুনাপাথরের স্টুকো অলংকরণে নির্মিত মন্দিরগুলি মূলত তিনটি মন্দিরকে কেন্দ্র করে বিভক্ত। নবরত্ন মন্দির, কালাচাঁদ মন্দির এবং রাসমঞ্চ। এছাড়াও বিচ্ছিন্ন ভাবে রয়েছে শীতলা ও ধর্মরাজ মন্দির। রাস্তার পাশে পাঁচটি খিলানযুক্ত প্রবেশদ্বার ও আলংকারিক স্তম্ভ সহ অবস্থিত কালাচাঁদ মন্দির। এর পিছনে তিনটি আট চালা শিব মন্দির এবং পঞ্চরত্ন শৈলীতে নির্মিত একটি মন্দির রয়েছে। রয়েছে দূর্গামন্ডপ। দূর্গামণ্ডপের পাশেই রয়েছে জরাজীর্ণ জমিদার প্রাসাদ, যার সিঁড়ি এখনও বিদ্যমান। রাস্তার আরও নীচে আটচালা এবং পঞ্চরত্ন শৈলীতে নির্মিত দুটি মন্দির রয়েছে। এই কালাচাঁদ মন্দির সংলগ্ন নির্মাণগুলিতে পোড়ামাটির কাজ বিদ্যমান।
পাথরা মন্দির গ্রাম
কালাচাঁদ মন্দির অংশের বিপরীতে রয়েছে নবরত্ন মন্দির। নয়টি চূড়া বিশিষ্ট নবরত্ন মন্দিরের পূর্বদিকে রয়েছে খিলানযুক্ত প্রবেশদ্বার। মন্দিরের সামনের দিকে পোড়ামাটির অলংকরণ। পাশে রয়েছে চারটি সমতল ছাদের শিব মন্দির এবং একটি তুলসীমঞ্চ। প্রবেশ দ্বারে রয়েছে চুনাপাথরের উপর পুষ্পশোভিত স্টুকো নকশা। রাস্তার ডান পাশে এবং কংসাবতী নদীর তীরে ধর্মরাজ মন্দির। কালাচাঁদ মন্দির চত্বর পেরিয়ে কিছুটা গেলেই পড়বে রাস মঞ্চ। এই রাস মঞ্চ নির্মাণ করেছে পাথরার বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার। রাস মঞ্চ চত্বরে রয়েছে তিনটি ইঁটের তৈরি পঞ্চরত্ন শিব মন্দির, অষ্টভুজাকার রাসমঞ্চ, কাছারিবাড়ি এবং আরও দুটি ছোট শিব মন্দির। তিনটি পঞ্চরত্ন মন্দিরে সূক্ষ্ম পোড়ামাটির অলঙ্করণ ও রাসমঞ্চে স্টুকো অলংকরণের চিহ্ন বিদ্যমান। এর থেকে বাম দিকে এগিয়ে দেউল শৈলীতে নির্মিত শীতলা মন্দির। বুড়িমার থান নামে পরিচিত এই মন্দির মজুমদার তথা ঘোষাল পরিবারের পারিবারিক দেবতা বলে কথিত আছে।
পাথরার মন্দির
একসময়ে সংরক্ষণের অভাব, কংসাবতীর বন্যা ও স্থানীয়দের সচেতনতার অভাবে প্রায় ধ্বংস হতে বসেছিল পাথরার ২৫০ বছরের অধিক প্রাচীন শিল্পকর্ম ও স্থাপত্যের নিদর্শনগুলি। পরে স্থানীয় কিছু শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষজন ও পাথরা প্রত্নতাত্ত্বিক সংরক্ষণ কমিটির ঐকান্তিক প্রচেষ্টার পর নিদর্শনগুলি পুরাতত্ত্ব বিভাগ অধিগ্রহণ করে সংরক্ষণ করে। কিন্তু পর্যটকদের জন্য অফুরন্ত আকর্ষণ থাকা সত্ত্বেও পাথরায় সেভাবে পর্যটক সমাগম হয়না। অনেক পর্যটক উৎসাহী হলেও সেখানে নেই সঠিক থাকার জায়গা, বিশ্রামের স্থান বা শৌচালয়। এমনকি পাথরা নিয়ে সঠিক প্রচারের অভাবও পরিলক্ষিত হয়। তবে পাথরাকে পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য সরকার। অর্থও বরাদ্দ হয়েছে। তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অনেক কিছু নষ্ট হচ্ছে বলে অভিযোগ। সঠিক প্রচার ও পর্যটকদের সুবিধার ব্যবস্থা গড়ে উঠলে পাথরা পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে বলে আশাবাদী স্থানীয়রা।