নেই কাজ, নেই উচ্চশিক্ষার নিশ্চয়তা; তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এপিডেমিকের রূপ নিচ্ছে অনিশ্চয়তা?

Published On:
লেটেস্ট আপডেট সবার আগে Join Now

দেবব্রত মণ্ডল~ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন ‘বিকেল ফুরিয়ে গেছে, রাত্রি আসছে অন্য দেশ থেকে।’ এই সময়ে দাঁড়িয়ে ঠিক এই প্রশ্নটাই বোধহয় বর্তমান প্রজন্মের মগজের গ্রে সেলগুলোকে সবথেকে বেশি ভাবায়। সত্যিই কি ফুরিয়ে গেছে সেই মায়ামাখানো হলুদ বিকেল? ঘনিয়ে আসছে রাতের কালো অন্ধকার? কিন্তু একুশ শতকের এই ব্যস্ত পৃথিবীতে যখন বিজ্ঞান এগিয়ে গেছে বেশ কয়েক কদম, মানুষ চাঁদের পাট চুকিয়ে মঙ্গলগ্রহে পাড়ি জমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং সর্বোপরি মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে বেশ কয়েক বছর তখন তরুণ প্রজন্মের মনে এই প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে কেন? তারাই তো এগিয়ে নিয়ে যাবে আগামীর পৃথিবীকে। সেই তাদের মনেই কেন এই অনিশ্চয়তা? সেই প্রশ্নেরই উত্তর দিয়েছেন বিশিষ্ট মনোবিদ মেগ চে। কিছুদিন আগেই বেশকিছু তরুণ – তরুণীকে নিয়ে একটি সমীক্ষা করেছেন তিনি। আর সেই সমীক্ষায় উঠে এসেছে চমকে দেওয়ার মতো তথ্য।

মেগ চের দাবি বেশিরভাগ কুড়ি বছর বয়সী বা তার বেশি বয়সের তরুণ এই ‘অনিশ্চয়তা ‘ নামক রোগে আক্রান্ত। কারণ যতদিন তারা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে ততদিন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা তাদের শিক্ষক – শিক্ষিকারা তাদের গাইড করেন যে পরবর্তী ধাপে তাদের কী করতে হবে। বুঝিয়ে দেন তাদের দুর্বলতাগুলো। কিন্তু কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস আউট হওয়ার পরে তাদের খুঁজতে হয় কাজ। মাথার উপর আসতে থাকে নানা সাংসারিক দায় – দায়িত্ব। ফলে অনেকেই এই নতুন পৃথিবীতে এসে নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে না পেরে হাবুডুবু খায়।

আরও পড়ুনঃ ইট ছোঁড়া ‘মৃগয়া’ নয়, অশ্লীলতা ‘ডিস্কো’ নয়

কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় উত্তীর্ণ হবার পরে কেউ হয়তো স্বপ্ন দেখে ভালো চাকরির, কেউ বা উচ্চশিক্ষার। কিন্তু এখানে তো সাফল্যের কোন ফর্মুলা নেই, নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক – শিক্ষিকাদের মতো গাইড করার কেউ। ফলে অনেকক্ষেত্রেই ব্যর্থ হতে হয় তাদের। আর তখনই তাদের ঘিরে ধরে বিভিন্ন সমস্যা। এই সময় ঠিক কী ধরনের সমস্যা তৈরি হয় তরুণ – তরুণীদের মনে? মনোবিদ পম্পি বন্দ্যোপাধ্যায় এই প্রসঙ্গে জানালেন – ‘এই অনিশ্চয়তা বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে একটা অতিমারীর রূপ নিয়েছে। কারণ এই সময় চাকরির কোন নিশ্চয়তা নেই, নেই উচ্চশিক্ষার নিশ্চয়তা। ফলে শুরু হয় ডিপ্রেশন। এবং সেটা বাড়তে বাড়তে একটা সময় এই তরুণ – তরুণীদের মধ্যেই আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা যায়। তাদের মধ্যে প্রশ্ন ওঠে, আমাকে দিয়ে হবে তো? পারব তো আমি! তবে এই অনিশ্চয়তা সবসময় যে নেগেটিভ ইম্প্যাক্ট ফেলে তা নয়। কারণ কেউ যদি একবার ভাবতে পারে আমি পারব, এই চ্যালেঞ্জটা নিতে হবে আমায় তাহলে সে কিন্তু দিনের শেষে জিতে যায়। এই পজিটিভ ভাবনাটা জরুরি।’

মনোবিদ মেগ চের দাবি অনিশ্চয়তা বর্তমান প্রজন্মকে এমনভাবে চেপে ধরেছে যে তারা ৩৫ বছর বয়সের মধ্যে গড়ে নয়বার চাকরি পরিবর্তন করছে। অর্ধেকের বেশি তরুণ – তরুণী বাড়ি থেকে আর্থিক সাহায্য নিতে বাধ্য হচ্ছে। করোনা পরবর্তী সময়ে এই সমস্যা আরও বেড়েছে।

অনেকেই মনে করেন বর্তমান প্রজন্ম মোবাইলে ডুবে থাকে, তারা অলস। তাদের নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য নেই। সেই কারণেই তারা আর্থিক ক্ষেত্রে এখনও অভিভাবকদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেন, এইভাবে চলতে চলতে একসময় তাদের ঘিরে ধরে ডিপ্রেশন। কিন্তু সত্যিই কি তাই? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় কিন্তু তাদের সঙ্গে একমত না। সঞ্জয়বাবু এই প্রসঙ্গে বললেন, ‘দেখুন বর্তমান প্রজন্ম যথেষ্ট সম্ভবনাময়। তাদের অলস, আড্ডাবাজ বলে দাগিয়ে দেওয়া ভুল। কারণ আমি মনে করি তাদের এই অবস্থার কারণ সামাজিক আদর্শশূন্যতা। তারা বুঝে গেছে আজকাল অমলেশ ত্রিপাঠী, প্রফুল্ল সেনের মতো শিক্ষক তারা পাবে না। তাই তারা কোনক্রমে অন্ন সংস্থানের চেষ্টা করছে। আমরা তাদের স্বপ্ন দেখতে শেখায়নি, উল্টে তাদের স্বপ্নটাকে কেড়ে নিয়েছি। তারা স্বার্থপর সমাজে বাঁচতে বাঁচতে কঠিন বাস্তবটা বুঝে ফেলেছে। এর দায় আমাদেরই নিতে হবে।’

সময় এগিয়ে চলছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছুটে চলেছি আমরা। আমাদের সমাজের প্রত্যেকটা তরুণ – তরুণী চায় একটা নিশ্চিন্ত জীবন, তারা দেখতে চায় বাবা – মায়ের হাসিমুখ, চায় বাবা – মাকে কিছু ফিরিয়ে দিতে। তারা চাইছে কিন্তু পারছে না। এই প্রতিযোগিতার ইঁদুরদৌড়ের মধ্যেই ঝরে যাচ্ছে কত প্রতিভা। দশটা – পাঁচটার অফিস টাইমে গুমরে গুমরে কেঁদে উঠছে তারা। তাদের স্বপ্ন দেখতে দিন, স্বপ্ন দেখতে শেখান। তাদের বাঁচতে দিন…।