বদলাচ্ছে সময়, বদলাচ্ছে মানুষের চাহিদা আর এই চাহিদা পূরণের তাগিদেই মানুষ আজ নিজেদের ঘর ছেড়ে উঠে আসছে শহরে। প্রতি মুহূর্তে বদলে যাওয়া এই সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে সে ভুলে যাচ্ছে নিজের শিকড়ের কথা, নিজের মাটির গন্ধ, নিজের ঐতিহ্যের মধুরতাকে। পশ্চিমবঙ্গের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য লোকসংস্কৃতি তাই আজ অনেকাংশেই বিলুপ্তির পথে। বাংলার মাঠে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লোকগান, লোকনৃত্য কিম্বা লোকশিল্প আজ চর্চার অভাবে ‘হেলায় মাটিতে গুমরে মরছে’ বললেও বেশি বলা হয় না। বাংলার ছৌনাচ, ঝুমুর, ভাটিয়ালি কিম্বা বাউল গান – বিশ্বের দরবারে আলোকিত হলেও বেশিরভাগ লোকসংস্কৃতির ধারা আজও অন্ধকার নিমজ্জিত। তেমনই একটি লোকনৃত্যের ধারা হল গম্ভীরা (Gambhira Dance)।
আরও পড়ুনঃ বাঙালির বিধি বাম – কলমে শুভময় মৈত্র
আনুমানিক ১২০০-১৫০০ শতাব্দীতে পালযুগের সমসাময়িক এক লোকনৃত্য হল এই গম্ভীরা। চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ-এর দিনপঞ্জিকাতেও হদিশ মেলে গম্ভীরার। ছৌ-এর মতো, এই নৃত্যও পরিবেশিত হয় মুখোশ পরিধানের মধ্যে দিয়ে। ক্ষেত্র বিশেষে এই গম্ভীরা আবার গামিরা নামেও পরিচিত। ‘গম্ভীরা’ অথবা ‘গামিরা’ নামের পিছনে কী কারণ রয়েছে তা সঠিক ভাবে জানা যায় না। তবে নামকরণ সংক্রান্ত দুটি মত গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে। অনেকে মনে করেন, গামার গাছের কাঠ দিয়ে এই নৃত্যের মুখোশ প্রস্তুত করা হয় বলেই এর নাম গম্ভীরা। আবার অনেকে মনে করেন, ‘গম্ভীর’ অর্থে মূলত দেবাদি-দেব মহেশ্বরকেই এখানে বোঝানো হয়েছে। মনে করা হয়, অশুভ শক্তিকে সংহারের মাধ্যমেই শুভ শক্তির আগমণ ঘটবে এবং ফলস্বরুপ মাঠ ভরে উঠবে সোনালী ধানে। ‘অন্নদামঙ্গল’-এ ভারতচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’। গ্রামবাংলার অধিকাংশ উৎসবের মধ্যেই তাই দেখা যায়, মানুষ দেব-দেবীর আরাধনা করে তাঁদের তুষ্ট করেন, দুবেলা দু’মুঠো ভাতের আশায়। ‘গম্ভীরা’ তার ব্যতিক্রমী নয়।
বছর শেষে চৈত্র সংক্রান্তির সময় জুড়ে পশ্চিমবঙ্গের মালদা এবং দিনাজপুরের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষেরা মেতে ওঠেন এই গম্ভীরা উৎসবে। এই অঞ্চলের নিম্নবর্গীয় হিন্দু, রাজবংশী, পোলিয়া এবং নমঃশূদ্রদের মধ্যেই এই নৃত্যের প্রচলন বেশি লক্ষ্য করা যায়। মালদার ইংরেজবাজার, বামনগোলা, আইহো, ভূতনি, গাজোল, মধুঘাট, বাচামারি ইত্যাদি জায়গাগুলিতে এই নাচের বিশেষ প্রসার রয়েছে আবার দিলাজপুরে এই নাচ প্রচলিত ‘ গামিরা’ নামে। পূর্বে সাতদিন ধরে টানা এই নৃত্য পরিবেশিত হলেও বর্তমানে চারদিনেই সাঙ্গ হয় এই উৎসব।
গোড়ার দিকে এই নৃত্যের বিষয় কেবলমাত্র ফসল এবং হিন্দু পৌরাণিক দেব-দেবীকেন্দ্রিক থাকলেও পরবর্তীতে গ্রাম্য জীবনের দৈনন্দিন ঘটনাসমূহও নৃত্যে স্থান পেতে থাকে। তাই বর্তমানে নৃত্য পরিবেশনের সময় যে সকল মুখোশের ব্যবহার করা হয়, সেগুলিকে মূলত পাঁচভাগে ভাগ করা যায় – হিন্দু পৌরাণিক দেব-দেবীর মুখোশ, গ্রামীণ বা লোকায়ত মুখোশ, প্রাণী সম্পর্কিত মুখোশ, ব্যঙ্গাত্মক মুখোশ এবং কিছু মিশ্ররীতির মুখোশ। প্রথমদিকে মুখোশ নির্মানের ক্ষেত্রে কাঠের ব্যবহার করা হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আজ কাগজের পাল্প দিয়ে মুখোশ তৈরি করা হচ্ছে। যদিও গম্ভীরা কখনও কখনও মুখোশ ছাড়াও পরিবেশিত হয়ে থাকে। গম্ভীরায় মূলত পুরুষেরাই অংশগ্রহণ করে থাকেন। নর্তকেরা নৃত্য পরিবেশনের সময় কখনও বিভিন্ন ভঙ্গিমায়, কখনও শুয়ে, কখনও বা উদ্দাম রূপে আবার কখনও ভ্রামরীতে ঘুরতে থাকেন। অতীত সময়ে নর্তকেরা গায়ে সোনার গয়না পরতেন এবং পায়ে বাঁধতেন নুপূর। বর্তমানে সোনার বেশ ঘুচেছে , নুপূরের বদলে স্থান কেড়েছে ঘুঙুর।