দেবব্রত মণ্ডল~ পুরুলিয়ার বন্দোয়ান থেকে যে রাস্তাটা জঙ্গলের গা ঘেঁষে চলে যাচ্ছে ঝাড়খণ্ডের দিকে, সেই রাস্তায় ঘন্টাখানেক গেলেই চোখে পড়ে কোডিয়া গ্রাম। গ্রাম – বাংলার আর পাঁচটা সাধারণ গ্রামের সঙ্গে এই গ্রামের খুব একটা পার্থক্য চোখে পড়ে না। বেশিরভাগ মানুষেরই জীবিকা কৃষিকাজ। শান্ত, নিস্তরঙ্গ জীবন। না, এই গ্রামে কোনদিন কোন নেতার দেখা মেলে না, ব্যতিক্রম লোকসভা অথবা বিধানসভা ভোটের দিনগুলো। এসব দিনে কোডিয়া গ্রামের মানুষগুলোর জন্য মনে জমে ওঠে প্রতিশ্রুতির পাহাড়। তিনরাস্তার মোড়ে শেষ বিকেলের মনখারাপ করা আলোয় বিষ্টুর চায়ের দোকানে জমে ওঠে আড্ডা। না, রাজনীতির দাদা – দিদিদের কাছে খুব বেশি কিছু চাওয়ার নেই তাদের। হয়তো এবার চাষের সময় জলটা পাওয়া যাবে, এবছর বৃষ্টির দেখা নেই যে এখনও। ওই বাবু তো বললেন ভোটে জিতলে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলটা সারিয়ে দেবে। বর্ষার সময় ছাদ থেকে জল পড়ে যে।
আরও পড়ুনঃ এক-তৃতীয়াংশ আসনে জিতবে বাম-কংগ্রেস জোট- মুখোমুখি মহম্মদ সেলিম
ঝাড়খণ্ডের কোডিয়া গ্রাম রাজনীতির দাদা – দিদিদের ম্যাপের বাইরে। ভোট আসে, ভোট যায়। এখানকার মানুষগুলো পড়ে থাকেন অথৈ জলে। মাসকয়েকের হাড়ভাঙা পরিশ্রমে জমি ভরে ওঠে সোনারঙা ধানে, অথচ কোন এক নিঝুম, নিশ্চুপ রাতে হাতির দল পায়ে পিষে যায় সেই সোনাগলানো ধানের ক্ষেত, সেইসঙ্গে পিষে যায় চাষির বুকের গভীরে সযত্নে বেড়ে ওঠা এক স্বপ্নকে। তারপর, বনদফতর থেকে পঞ্চায়েত, কত ছোটাছুটি, একটু ক্ষতিপূরণ যদি মেলে। না হলে যে ঘরের কাচ্চা – বাচ্চাগুলোর মুখে দুটো দানা তুলে দেওয়া ভার। পুরুষমানুষের তবু চলে যায় কিন্তু বউই বা কতদিন একটা শাড়ি সেলাই করে পড়তে পারে? সেদিনই না বলছিল পুকুরঘাটে বাসন ধোয়ার সময় রামু কেমন বুকের ছেড়া অংশটার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল? পেলে যেন গিলে খায়। ঝাড়খণ্ডের এই কোডিয়া গ্রামেই জন্ম সোনামণি টুডুর। হ্যাঁ, সেই সোনামনি টুডু যিনি এবারের লোকসভা ভোটে ঝাড়গ্রাম থেকে লড়ছেন সিপিএমের প্রতীকে। এমন একটা অখ্যাত গ্রাম থেকে উঠে এসেছেন সোনামণি, যেখানে বাঁচার একটাই অর্থ – লড়াই। সুতরাং লড়াই যেন সোনামনির রক্তে। পঞ্চায়েতের লড়াই থেকে এবার সোজা লোকসভা। সোনামনি কিন্তু কম পথ পাড়ি দেননি। আর কয়েকদিন পরেই ঝাড়গ্রামে লোকসভা ভোট। সোনামণির এখন নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। তার মধ্যেই সোনামনির সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে উঠে এল ঝাড়গ্রামের মানুষের সমস্যা, মাওবাদী সমস্যা, সবার হাতে কাজ – সবার পেটে ভাতের মত একাধিক ইস্যু।
প্রশ্ন : লোকসভা ভোট চলছে । সিপিএম নেতৃত্ব বারবার বলছে তারা লড়াইয়ে আছে। কিন্তু এর মধ্যেই একটা প্রশ্ন বারবার উঠছে। সিপিএমের মধ্যে সেভাবে আদিবাসী মুখ উঠে আসছে না কেন? মূল সমস্যাটা কোথায়?
সোনামণি : এটা একদম ভুল কথা। আদিবাসীরা আমাদের সমর্থন করছেন। তারা বুঝতে পারছেন বিজেপি – তৃণমূল কেউই তাদের কথা ভাবছে না। সমস্যাটা অন্য জায়গায়। তৃণমূলের শাসনে আদিবাসীরা যে সন্ত্রাস দেখেছে তাতে তারা ভয় পাচ্ছে। তার উপর প্রচারের জন্য বিজেপি বা তৃণমূল যেভাবে টাকা খরচ করছে তেমন অর্থ আমাদের হাতে নেই। কিন্তু যেটুকু অর্থ আছে, তাতে যেটুকু প্রচার সম্ভব হচ্ছে সেখানে আমরা বিপুল জনসমর্থন পাচ্ছি।
প্রশ্ন : ঝাড়গ্রাম – পুরুলিয়া এসব অঞ্চল আদিবাসী অধ্যুষিত হলেও এখানে বিজেপির জনসমর্থন কিন্তু প্রবল। সেক্ষেত্রে আপনি এবারের লোকসভা ভোটে নিজেকে প্রার্থী হিসেবে ১০ – এ কত দেবেন?
সোনামনি: দেখুন, প্রার্থী হিসেবে আমি কেমন সেটা বলবেন সাধারণ মানুষ। আমি এখানে আদিবাসীদের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। আমি ওদের ঘরের মেয়ে। অমিত শাহ যেভাবে প্রকাশ্য জনসভায় এসসি – এসটি মুর্দাবাদ স্লোগান তুলছেন, বা যেভাবে আদাবাসীদের অরণ্যের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে সেটা একটা মারাত্মক সমস্যা। আমার লড়াই এর বিরুদ্ধে। এস সি এস টি দের অধিকারের পক্ষে। বাকিটা তো মানুষ সিদ্ধান্ত নেবেন। তারা কাকে যেতাবেন।
আরও পড়ুনঃ “নির্বাচন হোক রোটি-কাপড়া-মকানের দাবিকে সামনে রেখে” মুখোমুখি-প্রতীকউর রহমান
প্রশ্ন : ঝাড়গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ কৃষিজীবী। কিন্তু বর্তমান সময়ে সার, বীজ কীটনাশকের দাম যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে তো এই অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে ১০০ দিনের কাজ বন্ধ। তারপরেও বিজেপিকে এখানকার মানুষ বিজেপিকে বিকল্প হিসেবে বেছে নিচ্ছে কেন?
সোনামণি: কী জানেন তো এর একটা বড় কারণ সোশ্যাল মিডিয়া। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বিজেপি মানুষদের মনে একটা ভুল ধারণা তৈরি করছে, বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। সেইসঙ্গে আছে মেন স্ট্রিম মিডিয়া। প্রায় প্রতিটা মেনস্ট্রিম মিডিয়ায় এখন বিজেপির হয়ে কথা বলে। ফলে সাধারণ মানুষ বুঝতেই পারছে না কোনটা ভুল, কোনটা ঠিক।
প্রশ্ন : একের পর এক সরকারি স্কুল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিজেপি সরকার বেসরকারিকরণের কথা বলছে। রাজ্যের সরকারও নিয়োগ দুর্নীতি সহ বিভিন্ন ইস্যুতে ব্যাকফুটে। এর ফলে কিন্তু সবথেকে বেশি অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে আদিবাসী সমাজ। তাদের বেশিরভাগের বেসরকারি স্কুলে পড়ার আর্থিক সংস্থান নেই। ফলে অচিরেই স্কুলছুট হয়ে পড়ছে। একটা প্রজন্ম তো শেষ হয়ে যাচ্ছে। কী বলবেন?
সোনামণি: আমাদের লড়াইটা কিন্তু এদের জন্যই। আমরা বলছি সবার পেটে ভাত, সবার হাতে কাজের কথা। একইরকমভাবে স্বাস্থ্য, শিক্ষার উন্নতিও আমাদের লক্ষ্য। শুধু বিজেপি নয় তৃণমূল সরকারও চাই শিক্ষার বেসরকারিকরণ। নাহলে এই যে এত এত স্কুল বন্ধ হচ্ছে, কারও কোন হেলদোল দেখছেন? আমরা যদি ক্ষমতায় আসি তাহলে প্রাইমারি থেকে উচ্চশিক্ষা কোনক্ষেত্রেই বেসরকারিকরণকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। শুধু তাই নয়, আমরা বলছি শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির কথা, এমনকি আইসিডিএস থেকে সিভিক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে যেসব চুক্তিভিত্তিক কর্মীরা কাজ করেন তাদেরও স্থায়ীকরণ করা হবে।
প্রশ্ন : আপনি এর আগে মহিলাদের জন্য বহু কাজ করেছেন। স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে আপনার কাজ আদিবাসীদের মধ্যে বিপুল সাড়া ফেলেছে। ভোটে জিতলে মহিলাদের জন্য বিশেষ কোন পরিকল্পনা আছে?
সোনামণি: অবশ্যই আছে। তবে শুধু মহিলা কেন? আমি ভোটে জিতলে ঝাড়গ্রামে শিল্প হবে, বেকার যুবক – যুবতীরা কাজ পাবে। ঝাড়গ্রামে হাতির প্রকোপ খুব বেশি। অথচ বেশিরভাগ সময় ক্ষতিপূরণ মেলে না। আমি চাই এমন ব্যবস্থা হোক যেখানে বন্যপ্রাণ এবং মানুষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে পারে। ঝাড়গ্রাম এলাকায় বালি মাফিয়াদের বাড়বাড়ন্ত বেশি। সবাই সব জেনেও কিছু বলে না। তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেব। ইচ্ছে আছে ক্ষমতায় এলে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে ফের পাট্টা ব্যবস্থার প্রচলন করার। তবে মহিলাদের জন্য বলবো আমরা ভোটে জিতলে বরাদ্দ বাজেটের ১ ভাগ খরচ করা হবে মহিলাদের জন্য।
প্রশ্ন: জঙ্গলমহল আর মাওবাদী একসময় সমার্থক ছিল। আপনাদের বহু নেতা – নেত্রী খুন হয়েছেন মাওবাদীদের হাতে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পর মাওবাদী হামলা নেই বললেই চলে। মাওবাদীরা অনেকে ফিরে গেছেন সমাজের মূল স্রোতে। তাহলে তো আপনাদের মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানানো উচিত।
সোনামণি : ধন্যবাদ কীসের জন্য? রাতে যারা মাওবাদী, দিনে তারাই তো তৃণমূল। ছত্রধর মাহাতকে দেখেননি আপনারা? আর মাওবাদীরা যদি তৃণমূল না হবে তাহলে শুধু খুঁজে খুঁজে সিপিএমকে মারবে কেন? দেখছেন না তৃণমূল ক্ষমতায় আসতেই মাওবাদীদের চাকরি হয়েছে। ওই কিষেনজি থেকে ছত্রধর সবাই মাওবাদী, সবাই তৃণমূল।
সোনামণি টুডু, সিপিএমকে নতুন করে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন তিনি। অথচ একসময় এই আসন নিয়েও দ্বিধায় ভুগেছে সিপিএম। তারা চেয়েছিল আসনটা আইএসএফকে ছেড়ে দিতে। শেষপর্যন্ত জোট হয়নি, প্রার্থী হয়েছেন সোনামণি। গত পঞ্চায়েত ভোটে আসনপাণিতে জিতেছিলেন সোনামণি। আর একবার কী সেই ফলের পুনরাবৃত্তি হবে? সোনামণি জানেন লড়াইটা কঠিন। কিন্তু তার লড়াই তো আদিবাসীদের পেটে ভাত, তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যের জন্য। সেই লড়াইয়ে ভর করেই সোনামণি এগিয়ে চলেছেন। সাইকোলজিতে স্নাতকোত্তর সোনামণি কী ঝাড়গ্রামের মানুষের মন জিততে পারবেন? উত্তর মিলবে ৪ই জুন।