বাঙালির বিধি বাম-শুভময় মৈত্র

Published On:

খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন এই লোকসভা নির্বাচনের ফলপ্রকাশের পর সামনে আসছে। তা হল নির্বাচনী রাজনীতিতে বামপন্থীদের গুরুত্ব এখন ঠিক কোন জায়গায়? গোটা দেশে তাদের আসন মোট আট, সিপিআই দুই, সিপিআইএম চার, সিপিআইএমএল দুই, অর্থাৎ অক্ষর এক এক করে বাড়লেও আসন গোটা দেশে আটখানা, যা মোটেও বামপন্থীদের জন্যে মোটেও আহ্লাদের খবর নয়। তাদের সেরা ফল ছিল ২০০৪ লোকসভা নির্বাচনে, সেবার লোকসভায় বামফ্রন্টের আসন ষাট পেরিয়েছিল, যার মধ্যে সিপিআইএম ছিল ৪৩, আর সিপিআই ১০। গোটা দেশে সিপিআইএমের ভোট শতাংশ ছিল ৫.৬৬%, আর এবার বিশ বছর পরে সেটা কমে ১.৭৬%। তুলনা করতে গিয়ে এক অদ্ভুত তথ্য চোখে পড়ল, পশ্চিমবঙ্গে এবার সিপিআইএমের ভোট শতাংশ ৫.৬৭%, দুই দশক আগে যা গোটা দেশে ছিল। রাজ্যে এবার তারা জোট বেঁধে লড়েছেন, সেই হিসেব ধরলে এবার বাম-কংগ্রেস জোট ১১% এর কাছাকাছি, ২০২১ বিধানসভায় ১০% এর থেকে সামান্য বেশি। বিশেষ করে আসনের হিসেবে পরপর তিনটি নির্বাচন, ২০১৯ লোকসভা, ২০২১ বিধানসভা, এবং ২০২৪ লোকসভা, বামপন্থীদের আসন শূন্য। মাঝে বিভিন্ন পুরসভা বা পঞ্চায়েতে তারা অল্প কিছু আসন পেয়েছেন। কিন্তু মূল তিনটি নির্বাচনে এই শূন্যের হ্যাট্রিক অবশ্যই সিপিআইএম দল বা বামপন্থী জোটের কাছে দুশ্চিন্তার।

আরও পড়ুনঃ পালট সিমরান পালট: দল বা জোট বদলু

এবারের বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণ প্রচারে বেশ খানিকটা এগিয়েছিল সিপিআইএম। বিশেষ করে শহরতলী অঞ্চলের তিনটি লোকসভা কেন্দ্রে, অর্থাৎ যাদবপুর, দমদম এবং শ্রীরামপুরে সিপিআইএম প্রার্থীদের প্রচার একেবারে প্রথম দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে ছিল। স্বাভাবিকভাবেই শাসক তৃণমূল যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে প্রচার করেছে। অন্যদিকে সিপিআইএমের সঙ্গে তুলনায় বিজেপির প্রচার ছিল অনেক নিষ্প্রভ। সঙ্গে এটা মানতেই হবে যে সাংগাঠনিক ক্ষমতাতেও যাদবপুর, দমদম এবং শ্রীরামপুরে বিজেপির তুলনায় এগিয়ে ছিল সিপিআইএম। এইখানেই একটি অদ্ভুত প্রশ্ন উঠবে। মেনে নেওয়া যাক বুথ নিয়ন্ত্রণ পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের একটি চরিত্র, এবং রাজ্যে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে সেই জায়গায় তৃণমূলের প্রভাব বেশি। কিন্তু এই তিন আসনে তৃণমূলের কর্মীরা নিজেদের ভোট নিশ্চিত করে জিতেছেন, এবং তারপর বিজেপিকেও ভোট পাইয়ে দ্বিতীয় করে দিয়েছেন, এই সেটিং এর যুক্তি ধোপে টেকে না। সিপিআইএমের প্রার্থীরাও এই অভিযোগ করেন নি। অর্থাৎ তৃণমূল বিরোধিতায় সিপিআইএম প্রার্থীর তুমুল জনপ্রিয়তা এবং দলের যথেষ্ট সংগঠন সত্ত্বেও মানুষ ভোট দেওয়ার সময় বিজেপিকে বেছে নিয়েছেন। এখানে যুক্তি দেওয়া যেতে পারে যে গোটা দেশের নিরিখে বিজেপি অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। কিন্তু তৃণমূল বিরোধিতায় কোন আসনেই বামপন্থীদের বেছে নিলো না ভোটাররা, এটা বেশ অবাক করার মত বিষয়। এই যুক্তিতে মুর্শিদাবাদের প্রসঙ্গে একটু পরেই আসছি। বামপন্থীরা কথায় কথায় আত্মবিশ্লেষণ করেন। কিন্তু এই তিন কেন্দ্রের ফলাফলে তাদের দোষ দেওয়ার কোন জায়গাই নেই। প্রার্থী বাছাই চমৎকার, মানুষ উৎসাহ দেখিয়েছেন, নেতা কর্মীরা পরিশ্রম করেছেন, মোটের ওপর নির্বিঘ্নে ভোট হয়েছে, তবুও ফল আশাব্যঞ্জক নয়। এক্ষেত্রে অপেক্ষা ছাড়া গতি নেই। এই প্রার্থীরাই তৃণমূল বা বিজেপির হয়ে দাঁড়ালে অনেক ভোট পেতেন। কিন্তু তাঁদের আদর্শ সেকথা বলে না। ফলে সেই নিরিখে তারা নিজেদের সেরা ফলটাই করেছেন। বড়জোর আইএসএফের সঙ্গে জোট না হওয়া নিয়ে অল্প আলোচনা হতে পারে। কিন্তু সেই ভোটের শতাংশ এই তিন কেন্দ্রে অঙ্ক কষার মত নয়, যাতে কিনা ফলাফলের গতি প্রকৃতি বদলে যেতে পারত। ফলে এক্ষেত্রে আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া ছাড়া আর কোন পথ নেই।

এবার আশা যাক মালদা-মুর্শিদাবাদের কথায়। প্রশ্ন যদি হয় সেটিং বা সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘুর বিভাজনের, সেক্ষেত্রে এই জেলার তিনটি লোকসভা আসনেই তৃণমূলের জেতার কথা, আর দ্বিতীয় হওয়ার কথা বিজেপির। কিন্তু তেমনটা হয় নি। এই তিন কেন্দ্রেই বিজেপির থেকে এগিয়ে থেকেছেন বাম কংগ্রেস জোটের প্রার্থীরা। তাহলে প্রশ্ন উঠবে, যে উইনেবিলিটি মুর্শিদাবাদে বাম-কংগ্রেস জোট দেখাতে পেরেছে তা কলকাতার আশেপাশে হল না কেন? পঞ্চায়েত নির্বাচন বা তার আগের বিধানসভা উপনির্বাচন থেকেই এটা পরিষ্কার যে মালদা মুর্শিদাবাদে এখনও অনেক জায়গায় কংগ্রেসের শক্তি বেশি এবং সেখানে যোগ্য সঙ্গত দেওয়ার জায়গায় আছে সিপিআইএম। দক্ষিণবঙ্গে আপাতত সিপিআইএমের ভোট কম, আর কংগ্রেসের একেবারেই নেই। এর কারণ একাধিক। সেই দীর্ঘ আলোচনায় না গিয়ে যেটা বলার চেষ্টা করছি তা হল তিনটি মূল বিষয় যা নিয়ে বামপন্থীরা মূলত আলোচনা করেছিলেন, সেগুলো নির্বাচনে তাদের হারের কারণ হতে পারে, তবে একমাত্র কারণ নয়। এক, তৃণমূল আর বিজেপির সেটিং এর কিছু উদাহরণ থাকতেই পারে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ভোটার সার্বিকভাবে তাতে গুরুত্ব দিচ্ছে না। দুই, ধর্মভিত্তিক বিভেদ সব ভোট গোটা বাংলায় তৃণমূল আর বিজেপির মধ্যে ভাগ করে দিয়েছে এই কথা সর্বত্র সত্যি নয়, উদাহরণ মুর্শিদাবাদ। আর তৃতীয়ত সাংগাঠনিক শক্তির অভাবে সিপিআইএম সব জায়গায় হেরেছে এটাও ঠিক কথা নয়, কারণ বিজেপি সেক্ষেত্রে অনেক জায়গাতেই দ্বিতীয় হতে পারতো না। এটা মানতেই হবে যে উত্তরবঙ্গের কিছু জায়গায় বা পূর্ব মেদিনীপুরে সাংগাঠনিক শক্তি বিজেপির জয়ে সাহায্য করেছে। সেটা না হলে তৃণমূল হয়ত সব আসনেই জিতে যেত। কিন্তু বেশ কিছু আসনে সেই সংগঠন শক্তিশালী না হওয়া সত্ত্বেও বিজেপি দ্বিতীয় হয়েছে বামেদের থেকে অনেক বেশি ভোট পেয়ে। ফলে বাংলার মানুষের রাজনৈতিক ভাবনায় যে অসরলরৈখিকতা আপাতত বামপন্থীদের পেছনে ফেলে দিচ্ছে তার সম্পূর্ণ বিশ্লেষণ করা হয়ত এই মুহূর্তে অসম্ভব। স্থান, কাল আর পাত্রের ভিত্তিতে আঙ্কিক বা রাশিবৈজ্ঞানিক অনুশীলন হয়ত গত তিনটি নির্বাচনে বামপন্থীদের স্থিতিশীল অথচ কম জনসমর্থনের কারণগুলিকে আংশিকভাবে নির্ধারণ করতে পারে, কিন্তু কি করে চটজলদি তাদের ভোট বাড়বে এটা বলা অবশ্যই শক্ত।