বাংলা ও বাঙালির ভোট উৎ-শব

Published On:
লেটেস্ট আপডেট সবার আগে Join Now

লেখা-দেবব্রত মণ্ডল
পথের হদিস পথই জানে, মনের কথা মত্ত
মানুষ বড় সস্তা কেটে ছড়িয়ে দিলে পারত

ঘটনা : ১

২৪শে, মে ২০২৪। মহিষাদলের সোনাখালি গ্রাম। ধামাইতনগর বাজার পেরিয়ে এগিয়ে চলেছে একটা মোটরবাইক। রাত পেরোলেই ভোট, ব্যস্ততার শেষ নেই মণিরুলের। শাসকদলের লড়াকু কর্মী তিনি। বিজেপির বিজয়রথ যখন বাংলাতেও প্রবেশ করতে শুরু করেছে সেই সময়ও মহিষাদল এলাকায় তিনি তার সংগঠনকে শক্তিশালী করেছেন দক্ষ হাতে। তমলুক লোকসভায় এবার তৃণমূলের লড়াইটা কঠিন। বিজেপির অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় অন্যদিকে সিপিএমের সায়ন ব্যানার্জী, দেবাংশুকে কেউ এক ইঞ্চি জমি ছেড়ে দেবে না। তার মধ্যে নিয়োগ দুর্নীতি, সন্দেশখালি এসব ইস্যু নিয়ে তৃণমূল বেশ কিছুটা চাপে। মণিরুলের মাথায় অনেক হিসেব – নিকেশ চলছিল। এখনও মাঝে – মধ্যে মণিরুলের ঘুমের মধ্যে হানা দেয় দুঃস্বপ্ন। সেই অভিশপ্ত দিনটার কথা মনে পড়ে ওর, ও শুনতে পায় গুলির শব্দ, চোখের সামনে ভেসে ওঠে খাকি উর্দি, পুলিশের জলকামান আর রক্তস্নাত রাজপথ। ১৯৯৩ সালের ২১ শে জুলাই। মণিরুলের চোখের সামনে তরতাজা ১৩টা প্রাণ ঝরে গেছিল সেদিন। ঘুম ভেঙে যায় মণিরুলের। দেখে ওর ছোট্ট মেয়েটা কেমন নিশ্চিন্তে গলা জড়িয়ে ঘুমোচ্ছে। মণিরুল ভরসা পায়, ওরা জিতবে, জিতবেই। মা – মাটি – মানুষ জিতবে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জিতবেন। আর মাত্র মিনিট দশেক, তারপর পৌঁছে যাবে বাড়ি। ছোট্ট মেয়েটা বাবা বলে গলা জড়িয়ে ধরবে। ওর আধো আধো গলার ডাকটা শোনার জন্য সারাদিন হা- পিত্যেশ করে বসে থাকে মণিরুল। বাইক আরও কিছুটা এগোয়, তারপর… অন্ধকার ফুঁড়ে ওর সামনে উদয় হয় কয়েকটা মুখ। মণিরুল চমকে ওঠে। তারপর…একটা আর্তচিৎকার।

ঘটনা : ২

নন্দীগ্রাম। পশ্চিমবাংলার বুকে কৃষক আন্দোলনের জন্মভূমি। যে আন্দোলন নাড়িয়ে দিয়েছিল তৎকালীন বাম সরকারকে। পশ্চিমবঙ্গ তথা সমগ্র ভারতের জনগণের মুখে তখন একটাই স্লোগান, ‘তোমার নাম আমার নাম নন্দীগ্রাম নন্দীগ্রাম’। অথচ এখন নন্দীগ্রামকে দেখলে মনে হওয়ার জো নেই যে কোন একসময় কৃষক আন্দোলনের দমকা হাওয়া বয়ে গিয়েছিল এই অঞ্চলের উপর দিয়ে, শাসকের গুলিতে অকালে চলে গেছে ১৪টা প্রাণ।

আরও পড়ুনঃ হাসপাতালে শিয়ালের তাণ্ডব, পরপর ১০ জনকে কামড়

নন্দীগ্রামের পলাশডাঙার বাসিন্দা অর্জুন মণ্ডল। সাধারণ কৃষিজীবী পরিবার। ঘড়িতে তখন রাত ১০ টা। অর্জুন সবে ভাতের থালাটা নিয়ে বসেছেন। হঠাৎ, বাড়ির দরজা ঠেলে প্রবেশ করল কয়েকজন – ‘ অর্জুনদা ওরা আবার এসেছে। বাজারের ওদিকটায় খুব ঝামেলা হচ্ছে। আমাদের ছেলেদের ধরে মারছে। না, সেদিন আর খাওয়া হয়নি অর্জুনের। ঝামেলার কথা শুনে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন অর্জুন, মায়ের পিছুডাককে অগ্রাহ্য করে পার্টির সহকর্মীকে বাঁচাতে ছুটেছিলেন অর্জুন। তারপর থেকে তার ঠিকানা হাসপাতাল। আপাতত কোমায় রয়েছেন তিনি। না, পার্টিকে ভালোবাসার মূল্য এইটুকুতে চোকাতে পারেননি অর্জুন। ছেলে ফিরছে না দেখে সেই রাতেই খুঁজতে বেরিয়েছিলেন অর্জুনের মা। খুন হয়ে যান তিনি। অভিযোগ শাসক দল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা পিটিয়ে, কুপিয়ে খুন করেছে তাকে। যে নন্দীগ্রামে জমি রক্ষা করতে গিয়ে অকালে ঝরে গিয়েছিল ১৪ টা প্রাণ সেই নন্দীগ্রাম আরও একবার স্নান করল রক্তে। শাসক বদলে যায়, অথচ বদলায় না তাদের টার্গেট। মণিরুল কিংবা অর্জুনের মায়ের মত অনেককে পার্টিকে ভালবাসার মাশুল দিতে হয় জীবন দিয়ে।

এবারের লোকসভা ভোটে বাংলার চিত্রটা ঠিক কেমন? ষষ্ঠ দফার ভোট ইতিমধ্যে শেষ। গড়বেতা, কেশপুর, মহিষাদল, নন্দীগ্রাম, ময়না, মন্তেশ্বর সহ বিভিন্ন জায়গায় খুন, অন্য দলের প্রার্থী থেকে বুথ এজেন্টদের মারধর, শাসক – বিরোধী সংঘর্ষের মত যে ছবিগুলো সামনে এসেছে তারপর বলা চলে বাংলার ভোট – হিংসার চিত্রটা মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। অথচ লোকসভা ভোটে প্রথম তিন দফার পরে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব গোয়েল রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক আরিজ আফতাবের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। কিন্তু ষষ্ঠ দফার ভোটের ঠিক আগে মহিষাদল থেকে নন্দীগ্রাম – যে ছবি তাতে নির্বাচন কমিশনের কপালে ভাঁজ পড়তে বাধ্য।

বাংলায় ভোট মানেই কি হিংসা? ইতিহাস অন্তত তাই বলছে। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে গণতন্ত্রের উৎসবে বলি হয়েছিলেন ৩৩ জন। সালটা ২০১৩, পঞ্চায়েত নির্বাচন সংক্রান্ত অশান্তিতে প্রাণ যায় ৩১ জনের, ২০১৮ সালে সংখ্যাটা পৌঁছে যায় ৭৫ জনে। শুধু পঞ্চায়েত ভোট নয়, একই ছবি বিধানসভা বা লোকসভা ভোটে। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে মারা যান ৯ জন, ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে মৃত্যু হয় ১৬ জনের। সুতরাং একটা কথা স্পষ্ট, ক্ষমতায় থাকতে চাইলে রক্তের হোলি খেলা অবশ্যম্ভাবী। জোর যার মুলুক তার – শাসক থেকে বিরোধী, বাংলার বুকে প্রত্যেকের নীতি একই। উপরের পরিসংখ্যানগুলি সবই তৃণমূল জমানার। তবে বাম সরকার তাদের শাসনকালে ভোট – হিংসার নিরিখে রীতিমত টক্কর দিয়েছে তৃণমূলকে। ২০০৩ সালে ভোট হিংসায় মৃত্যু হয়েছিল ৮০ জনের। সরকারি হিসেবে সংখ্যাটা অবশ্য ১৭। ২০০৮ সালে মারা যান ৪৫ জন। তবে সরকার এই তথ্য স্বীকার করেনি। তাদের হিসেবে মৃত্যুর সংখ্যা ১০।

আরও পড়ুনঃ নাবালক ও তরুনীর বিয়ের সমস্যার সমাধান করতে এসে বিপদে তৃণমূল নেতা

ভোট আসে ভোট যায়। বছর বছর বেড়ে চলে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সংখ্যা। সেই সঙ্গে জমে ওঠে নির্বাচন কমিশন আর রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিশ্রুতির পাহাড়। রাজাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে গিয়ে প্রাণ যায় উলুখাগড়াদের। নন্দীগ্রামের ঘটনার পর তৃণমূলের প্রতিনিধি দলের তরফে বলা হয়েছিল ওই অঞ্চলে তৃণমূলের সংগঠন শক্তিশালী নয়, তৃণমূল ওই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নয়। ঠিক একইভাবে মহিষাদলের ঘটনায় দলের কর্মীদের যুক্ত থাকার কথা অস্বীকার করেছে বিজেপি। অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ চলছেই। কিন্তু এই আমরা ওরা, কেন্দ্র – রাজ্য, শাসক – বিরোধী কোন্দলের মাঝেই চলে যায় মণিরুলের মতো তরতাজা প্রানগুলো, মৃত্যুর সঙ্গে প্রতিমুহূর্তে লড়াই করতে হয় অর্জুনদের। দল যেতে, বিজয় মিছিলে চলে উদ্দাম নাচ, তৈরি হয় শহীদবেদী। তাতে ওঠে নতুন মালা – ‘ শেখ মণিরুল অমর রহে, আমরা তোমায় ভুলছি না ভুলবো না।’ অথচ ভোলে তো সবাই। স্মৃতির অতলে তলিয়ে যায় মণিরুল কিংবা অর্জুনরা। শুকিয়ে আসে শহীদবেদির ফুল অথচ শুকোয় না স্বজনহারা পরিবারগুলোর চোখের জল। বিজয় মিছিলের আলোর মধ্যেও তাদের ঘরজোড়া অন্ধকার। তারপরেও অর্জুনের বোন আশায় বুক বাঁধে – খুনিরা শাস্তি পাবে, বদলাবে এ বাংলা, বন্ধ হবে রক্তস্নান। সকাল হতেই সে আবার যায় ভোটকেন্দ্রে, বোতাম টেপে ইভিএমের – আসলে গনতন্ত্র যে বিষম দায়।
( নাম এবং স্থান পরিবর্তিত)