দেবব্রত মণ্ডল: পথ দেখাচ্ছে মেদিনীপুর (Medinipur)। পথ দেখাচ্ছেন স্কুল শিক্ষকরা। রাজ্যজুড়ে শিক্ষক নিয়োগের প্রশ্নে একের পর এক দুর্নীতি যখন সামনে এসেছে, যখন শিক্ষকতার মতো মহান পেশাও প্রশ্নের মুখে ঠিক সেই সময় ভিন্ন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন মেদিনীপুরের (Medinipur) কিছু স্কুলশিক্ষক। পশ্চিম মেদিনীপুরের (Paschim Medinipur) শালবনী (Salboni) ব্লকের মৌপাল দেশপ্রাণ বিদ্যাপীঠ। স্কুলের একটা বড় অংশের ছাত্র-ছাত্রী আসে দরিদ্রসীমার নীচের পরিবার থেকে। সুতরাং, বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রী হারিয়ে যায় অকালে। কেউ চলে যায় দিনমজুরের কাজে, কোনও ছাত্রীকে পরিবারে একটা পেট কমাতে বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। যেসব অমলকান্তিরা রোদ্দুর হতে চেয়েছিল তারা পরিস্থিতির চাপে অকালেই হারিয়ে যায়, স্কুলছুট হয়ে পড়ে।
আরও পড়ুনঃ অবশেষে স্বস্তি, জামিন পেলেন হেমন্ত সোরেন
করোনা পরবর্তী সময় থেকে এই সমস্যা আরও বেড়েছে। উপায় খুঁজে না পেয়ে শেষপর্যন্ত হাল ধরেছেন স্কুলের শিক্ষক – শিক্ষিকারা। তারা স্কুলের প্রতিটি ছাত্র – ছাত্রীর বাড়িতে পৌঁছে যাচ্ছেন। বিচিত্র অভিজ্ঞতা মুখোমুখি হচ্ছেন সেখানে। ক্লাসে যে ছেলেটা সবথেকে ভালো আবৃত্তি করতো সেই হয়তো বাবার সঙ্গে গেছে চাষের কাজে। অথবা যে মেয়েটা দিয়ে যেত একের পর এক কঠিন প্রশ্নের উত্তর তারই বিয়ের তোড়জোড় চলছে। শিক্ষক – শিক্ষিকারা তাদের বাবা-মায়ের সাথে কথা বলছেন। তাদের বোঝাচ্ছেন, দরকারে সাধ্যমত আর্থিক সাহায্য করা হচ্ছে। তাদের আর্জি একটাই, বাড়ির ছেলে বা মেয়েটাকে যেন স্কুলে পাঠানো হয়। অভাব যেন গ্রাস করতে না পারে অমলকান্তিদের।
বেশকিছুদিন ধরেই মৌপাল দেশপ্রাণ স্কুলের শিক্ষক – শিক্ষিকারা লক্ষ্য করছিলেন ছাত্র ছাত্রীদের উপস্থিতির হার কমতে শুরু করেছে। সেইমতো পরিকল্পনা করেন তারা। তৈরি করা হয় স্কুলছুট পড়ুয়াদের তালিকা। তারপর শুরু হয় এইসমস্ত পড়ুয়াদের বাড়িতে গিয়ে অভিভাবকদের বোঝানোর পালা। জানা গেছে, অভাবের চাপে গরমের ছুটির মধ্যেই স্কুলের এক ছাত্রীর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিল তার পরিবার। বাল্যবিবাহ আটকে আবার তাকে স্কুলে ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন শিক্ষক – শিক্ষিকারা। তেমনই এক ছাত্র জানিয়েছে, দিনমজুরের কাজ করে বাবা টানতে পারছিল না পড়াশোনার খরচ। সেই কারণে স্কুল ছাড়ে সে। শিক্ষক – শিক্ষিকারা ঘটনার কথা জানতেই আর্থিক সাহায্য নিয়ে হাজির হয়েছেন বাড়ির দরজায়। ফের স্কুলে ফিরেছে সেই ছাত্র। এমনকি স্কুলে যাতায়াতের জন্য শিক্ষক – শিক্ষিকাদের তরফে দেওয়া হচ্ছে বাসের ভাড়া।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রসূন পড়িয়া বলেন, ‘বুঝতে পারলাম, অভিভাবকদের সচেতনতার অভাব স্কুলছুট হওয়ার প্রধান কারণ। বছরে একবার নয়, সারা বছরই এ বিষয়ে নজর রাখা হবে। ১৫ দিন অন্তর পর্যালোচনা মিটিং করা হবে। প্রয়োজনে আবার ওই ছাত্রছাত্রীদের বাড়িতে যাবেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা।’ একঝাঁক ইচ্ছেডানা এখন আবার খোলা আকাশে উড়তে পারছে। তাদের ওড়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন মৌপাল দেশপ্রাণ স্কুলের সেইসব শিক্ষক – শিক্ষিকারা। রাজ্য এবং দেশজুড়ে দুর্নীতি, শিক্ষায় অনিয়ম, ভর্তির নামে তোলাবাজি এবং সর্বোপরি নিদারুণ অভাবের মধ্যেই বাঁচার স্বপ্নে বিভোর আকাশ, উমারা।