পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত গ্রাম কঙ্কাবতী। এক সময় এই গ্রাম মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকা ছিল। দিন – রাত গ্রামের মানুষদের সঙ্গী ছিল একরাশ আতঙ্ক। দিনে যে মানুষগুলো হেসেছে আপনজনের মতো, ছুটে এসেছে বিপদের দিনে, রাতে তারাই মেতে উঠেছে রক্তের হোলিখেলায়। সেই সময় এই গ্রাম দেখেছে প্রত্যেক দিন মানুষের মৃত্যু। কত প্রাণ ঝরে গেছে অকালে, কোল ফাঁকা হয়েছে কত মায়ের। সেই জঙ্গলমহলের কঙ্কাবতী এলাকার মেয়ে সুমনা দাস। এক প্রকার জেদ করেই ৩ বছর বয়স থেকে নিজে শুরু করে রথের পুজো(Ratha Yatra)। এক সময় মেয়েটির বাড়ির লোক মনে করতো এটা নেহাতই একটা বাচ্চার জেদ। পরে তাদের ভুল ভাঙে। তারা বুঝতে পারেন, প্রভু জগন্নাথের আমার বাড়িতে পুজো পাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে। সেই ৩ বছরের সুমনা ২০০৪ সালে শুরু করেছিল রথের পুজো, সেই পুজো চলছে আজও। আজও সুমনা নিজের রথ সাজান, রথের পুজো করেন। সেই রথ নিয়েই ঘোরা হয় গোটা গ্রামে। গ্রামের মানুষদের খাওয়ানো হয় প্রসাদ।
আরও পড়ুনঃ Horoscope Today: আজকের রাশিফল ৭/৭/২০২৪
কীভাবে শুরু হল এ পুজোর? সুমনা দাস বলেন, ‘আমার বয়স তখন ৩ বছর। মায়ের সঙ্গে গ্রামের রথ দেখতে যেতাম। আমি সেই সময় গ্রামের বড় রথ না দেখে বাচ্চারা যে ছোট ছোট রথ নিয়ে ঘুরছিল সেটা দেখছিলাম। আমার নিজের রথ নেই বলে তখন কত কান্নাকাটি করেছি। তখন আমাদের গ্রামে একটা ফার্নিচারের দোকান ছিল। সেখানে একজন কাকু কাজ করতেন। আমার কান্নাকাটি দেখে ওই ফার্নিচার দোকানের কাকু রথ একটি বানিয়ে দেন। তখন সেই রথটি আমি নিজের সাজিয়ে পুজো শুরু করি। তারপরে যখন আমার বয়স ৫ বছর হলো, তখন এক দাদু বলেন তোর থেকে রথটা পুরোনো হয়ে গেছে, আগের থেকেও বড় একটা রথ বানিয়ে দেবো তোকে। ব্যাস, যেমন কথা তেমন কাজ। তৈরি হল বড় রথ। তখন থেকেই প্রত্যেক বছর এই ভাবে পুজোটা শুরু হয়ে গেলো। প্রথমে আমার বাড়ির লোকের মনে হতো এটা একটা বাচ্চার জেদ নয়, পরে তারা বুঝতে পারেন আসলে প্রভু জগন্নাথের আসার ইচ্ছে হয়েছে। এই ভাবেই ২০০০ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত চলে আসছে। রথের দিন গুলোতে এখনও প্রচুর আনন্দ হয়। সব মানুষ দুর্গাপূজা কবে হবে, সেই অপেক্ষা তে থাকে, আমি রথ কবে আসবে সেই দিকে চেয়ে বসে থাকি।’
একদিন ছোট্ট সুমনার হাত ধরে যে রথের পুজো শুরু হয়েছিল সেই পুজো আজ গোটা গ্রামের পুজো। আজ আর সুমনাকে একা হাতে রথ সাজাতে হয় না। রথযাত্রা উপলক্ষ্যে প্রচুর মানুষের সমাগম হয় গ্রামে। তারাই সাহায্য করেন। যত দিন যাচ্ছে সুমনার জগন্নাথের আরাধনার আয়োজনও বেড়ে চলেছে। একসময় যে গ্রাম রাতবিরেতে কেঁপে উঠত গুলির শব্দে, অথবা ভারি বুটের আওয়াজে সেই গ্রাম আজ মাতোয়ারা জগন্নাথের আগমন বার্তায়। সুমনা তো শুধু এখানে একটি পুজো শুরু করেননি, তিনি গ্রামের মানুষের মন থেকে উপড়ে ফেলেছেন ভয়কে, বেঁধেছেন একসূত্রে।