বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন এবং কয়েকটি প্রশ্ন

Published On:
লেটেস্ট আপডেট সবার আগে Join Now

দেবব্রত মণ্ডল: অবশেষে ‘স্বাধীন’ (!) হল বাংলাদেশ (Bangladesh)। কতটা স্বাধীন হল? যতটা স্বাধীন হলে ভেঙে ফেলা যায় বঙ্গবন্ধুর মূর্তি, যতটা স্বাধীন হলে আক্রমণ করা যায় সংখ্যালঘুদের উপর, যতটা স্বাধীন হলে সোশ্যাল মিডিয়ায় নির্দ্বিধায় লেখা যায় ‘পরবর্তী লক্ষ্য ভারত দখল করা’ ঠিক ততটাই। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন, বলা ভাল প্রাণের ভয়ে পালিয়েছেন। গোটা বাংলাদেশে জারি হয়েছে সেনাশাসন। বাংলাদেশকে ‘স্বাধীন’ ঘোষণা করেছেন আন্দোলনকারীরা। বিগত কয়েক বছরে শেখ হাসিনার বেশকিছু পদক্ষেপ যে বাংলাদেশের ছাত্র-যুব এবং সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভের সঞ্চার করছিল সেকথা অস্বীকারের উপায় নেই। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম আওয়াজ তোলে বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রী সমাজ। তাদের দাবি ছিল অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত। কী সেই দাবি? চাকরির ক্ষেত্রে কোটাপ্রথার সংস্কার। অর্থ্যাৎ চাকরির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার যে বিশেষ সুবিধা পেত তার বিরুদ্ধাচরণ করল বাংলাদেশের ছাত্ররা। ঠিক এখানেই শেখ হাসিনা একটা মারাত্মক ভুল করে বসলেন। তিনি আন্দোলনকারী ছাত্র- ছাত্রীদের রাজাকার বলে অভিহিত করলেন। ক্ষোভের আগুনে মুহূর্তের মধ্যে ঘৃতাহুতি হল। জন্ম নিল এক নতুন স্লোগান – ‘তুমি কে আমি কে? রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে? স্বৈরাচারী সরকার।’ এরপরের ঘটনা নিঃসন্দেহে ইতিহাস। ছাত্র – যুবদের ঢল নামল বাংলাদেশের রাজপথে। পুলিশ এবং সেনা নামিয়েও সেই স্বতস্ফূর্ত আন্দোলনকে রোখা সম্ভব হল না হাসিনার পক্ষে। মাঝে ঝরে গেল কিছু তরতাজা প্রাণ। শেষপর্যন্ত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট রায় দিল একপ্রকার আন্দোলনকারীদের পক্ষেই। মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা কমিয়ে আনা হল মাত্র পাঁচ শতাংশে। এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। সমস্যাটা তৈরি হল এরপরেই।

আরও পড়ুনঃ নেই কাজ, নেই উচ্চশিক্ষার নিশ্চয়তা; তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এপিডেমিকের রূপ নিচ্ছে অনিশ্চয়তা?

কী সেই সমস্যা? আন্দোলনকারীরা এবার শেখ হাসিনা সরকারের যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলল। তাদের বক্তব্য স্পষ্ট – এতগুলো মৃত্যুর দায় নিয়ে পদত্যাগ করতে হবে হাসিনাকে। এতদিন আন্দোলনকারীদের দমাতে পুলিশ অস্ত্র তুলে নিচ্ছিল হাতে, এবার ছাত্ররাও শুরু করল হিংসাত্মক আন্দোলন। কখনও জেল ভেঙে, কখনও ছাত্রলীগের নেতা – কর্মীদের পিটিয়ে কখনও বা তাদের হত্যা করে গোটা আন্দোলনের অভিমুখটাকেই পাল্টে দিল তারা। ঠিক এখানেই প্রশ্ন ওঠে – আন্দোলনের প্রথম দিন থেকে সরকার এমনকি রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একটা বড় অংশ বারবার বলে আসছিলেন স্বতস্ফূর্ত ছাত্র আন্দোলনের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে জামাতের মতো সংগঠনগুলি। ছাত্রদের সামনে রেখে, তাদের ব্যবহার করে নিজেদের রাজনৈতিক অভিসন্ধি পূরণ করতে চাইছে জামাত এবং আরও বেশকিছু সংগঠন। আন্দোলনকারীদের কয়েকটি পদক্ষেপ সেই প্রশ্নকেই আরও জোরালো করে তুলল। হাসিনার আমলে বাংলাদেশকে লড়তে হচ্ছিল বহু সমস্যার সঙ্গে। কিন্তু আজ যখন তিনি পদত্যাগ করে দেশ থেকে একপ্রকার পালিয়ে এলেন তখন তার অতি বড় বিরোধীও কি অস্বীকার করতে পারবেন যে হাসিনার সময়কালে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত ছিলেন। আজ যখন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ চলছে তখন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী মহল চুপ কেন? কেন তারা নিন্দায় সরব হয়ে উঠছেন না? আজ বাদে কাল বাংলাদেশে যে সরকারই আসুক তারা যে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? বিএসএফ ইতিমধ্যে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে হাই আল্যার্ট জারি করেছে। তারপরেও পদ্মাপারের এই অস্থিরতার আঁচ যে এদেশে এসে পড়েছে সেকথা অস্বীকারের উপায় নেই। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের বদলা নিতে ভারতে সংখ্যালঘুদের টার্গেট বানানো হলে তার দায় কী আন্দোলনকারীরা নেবেন? নাকি তখনও তারা ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ উদযাপনে বিভোর হয়ে থাকবেন?

না, এখানেই শেষ নয়। প্রশ্ন আরও আছে। কোটাবিরোধী আন্দোলনে তো একবারের জন্য ছাত্রদের তরফে ভারত বিরোধিতা দেখা যায়নি ( কিছুক্ষেত্রে ভারতবিরোধী স্লোগান উঠলেও তা একেবারেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত)। তাহলে আন্দোলনের জয়ের পর হঠাৎ ভারত বিরোধীতার সুর শোনা যাচ্ছে কেন? ভারত এমনকি বাংলাদেশের একটা বড় অংশের জনগণ শুধুমাত্র এই কারণেই আন্দোলনকারীদের উপর ক্ষুব্ধ। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে শুরু হয়েছে সেনাশাসন। কিন্তু প্রশ্ন এটাই, সেনাবাহিনী অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ঘোষণা করলেও নির্বাচনের মাধ্যমে স্থায়ী সরকার গঠন হবে কবে? আর সেনাবাহিনী যদি নির্বাচন করাতে চায় তাহলেও কোনভাবে সেনার একটা বড় অংশ সেই নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করবে না তো? কারণ বাংলাদেশ এবং পাকিস্থানে এর আগেও সেনাবাহিনী শাসনক্ষমতা হাতে নিয়েছে। সেনাবাহিনীর সেই শাসন যে খুব একটা সুখপ্রদ নয় তা নিশ্চয় বাংলাদেশের জনগণকে নতুন করে বোঝানোর প্রয়োজন নেই।

আরও পড়ুনঃ বাঙালির বিধি বাম-শুভময় মৈত্র

আজ প্রতিটা সংবাদমাধ্যম দেখিয়েছে আন্দোলনকারীদের রোষ কীভাবে বঙ্গবন্ধুর মূর্তির উপর আছড়ে পড়েছে। প্রশ্ন উঠেছে আন্দোলনকারীদের এই আচরণ নিয়েও। শেখ হাসিনা এবং বঙ্গবন্ধু যে এক নন, তাদের নীতির মধ্যে যে আকাশ – পাতাল পার্থক্য সেটা বোঝার জন্য রাজনৈতিক বোদ্ধা হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। লড়াইটা হাসিনার নীতির বিরুদ্ধে। দেশের এই অবস্থার জন্য, এই ক্ষোভের বিস্ফোরণের জন্য তিনি যে অনেকাংশে দায়ী একথা নিঃসন্দেহে সত্যি। কিন্তু সেই পাপের ভাগীদার মুজিব নন। একথা অস্বীকার করা চলে না বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছিল এই অগ্নিপুরুষের জন্যই।

বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ লড়েছে, বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করেছে। কিন্তু তখন একজন সংখ্যালঘু মার খাননি, নিরাপত্তার অভাববোধ করেননি। ভাঙা হয়নি মন্দির। বরং তারা বারংবার ডাক দিয়েছেন আরও বেঁধে বেঁধে থাকার। যে স্বাধীনতা সংখ্যালঘুদের কোল খালি করে, যে স্বাধীনতা তাদের আশ্রয়হীন করে দেয়, মুছে ফেলে সিঁথির সিঁদুর, মুগ্ধ, আবু সৈয়দরা সেই স্বাধীনতা বোধহয় চায়নি। তাই প্রশ্ন ওঠে সমস্ত প্রশাসনিক কাঠামো অপরিবর্তিত রেখে শুধু শাসক তাড়িয়ে, তাকে দেশছাড়া করে কি কোন দেশে বিপ্লব আনা সম্ভব? মনের মধ্যে তৈরি হয় আশঙ্কার মেঘ — সত্যিই তাহলে ছাত্রদের সামনে রেখে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিল কিছু মৌলবাদী? মুগ্ধ, আবুরা হয়তো আজকের বাংলাদেশ দেখতে চায়নি। তারা হয়তো আড়াল থেকে হতাশার হাসি হেসে বলছে তোমরাও পারলে না ভাই, পারলে না।