অরুণিমা মুখার্জী : গ্রীষ্মের তীব্র তাপদাহের পর যখন অবশেষে বর্ষা আসে দক্ষিণ ভারতে, নিষ্প্রাণ পরিবেশ ফিরে পায় তার আসল রূপ, তখনই তামিলনাড়ু মেতে ওঠে প্রকৃতি পুজোয়, ‘আদি পেরুক্কু’ (Aadi Perukku)। ‘তামিল’ ক্যালেন্ডারের চতুর্থ মাস পরিচিত ‘আদি মাস’ নামে। জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে অগাস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ই ‘আদি মাস’। এই সময়েরই এক উৎসব হল এই ‘আদি পেরুক্কু’ (Aadi Perukku)। প্রতিবছর আদি মাসের আঠারো তারিখে এই উৎসবটি পালিত হয়ে থাকে। ধরিত্রী মা’কে পূজার্চনার মধ্যে দিয়ে মানুষ প্রকৃতিকে কৃতজ্ঞতা জানায় আর কামনা করে নিজেদের সুখ সমৃদ্ধির। প্রকৃতির অঙ্গ হিসাবেই এই উৎসবে পূজিত হয় নদী, পুকুর, হ্রদ কিংবা কুয়োর মত জলাশয়গুলিও। আদি পেরুক্কুর আচার-অনুষ্ঠান মূলত অঞ্চলের মহিলারাই পালন করে থাকেন।
প্রকৃতি পুজো হলেও এই উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু কিন্তু মহালক্ষ্মী মন্দির। আটশো বছরের পুরনো এই মন্দিরটি অবস্থিত মহাদানাপুরামে। তামিলনাড়ুর কারুর জেলার থেকে ২৩ কিমি দূরে অবস্থিত এই মন্দিরটিতে যানবাহনের যে বিশেষ আনাগোনা রয়েছে, না নয়। তবুও প্রতিবছর পেরুক্কু উৎসবের সময় ভক্তদের ভিড় উপচে পড়ে এই দুর্গম মন্দির প্রাঙ্গণে। মাথায় নারকেল ভাঙার লোকাচারটিও সম্পন্ন হয় এই মহালক্ষ্মী মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের হাত ধরেই।
এই অদ্ভুত লোকাচারের পিছনে লুকিয়ে রয়েছে একটি লোকগাঁথা। বলা হয়, এই অঞ্চলের বাসিন্দারা একসময়ে শিবের উপাসনায় ব্রতী হয়েছিলেন কিন্তু অনেক সাধনার পরেও দেবাদি-দেবের দেখা মেলে না। তারপরেই তারা শিব দর্শনের অভিপ্রায়ে মরিয়া হয়ে নিজেদের মাথায় আস্ত আস্ত নারকেল ভাঙতে শুরু করেন। অতঃপর, ভক্তদের নিদারুণ পরীক্ষায় তুষ্ট হয়ে দেখা দেন ভোলা-মহেশ্বর। মনে করা হয়, শিবের তৃতীয় নয়নের সঙ্গে নারকেলের তিনটি চোখের তুলনা করেই নারকেল ব্যবহারের প্রচলন ঘটে।
এছাড়া প্রচলিত রয়েছে অন্য একটি গল্প। ব্রিটিশ আমলে যখন রেললাইন পাতার কাজ চলছিল তখন এ অঞ্চলের মানুষেরা তাতে বাধা দিলে ইংরেজরা তাদের সামনে একটি শর্ত রাখে। শর্তানুসারে বলা হয়, যদি তারা নিজেদের দেহ দিয়ে নারকেল ভাঙতে সক্ষম হয় তবেই তারা এই লাইন পাতার কাজ বন্ধ করবে। সেই শর্ত রাখতেই তারা নাকি নিজেদের মাথার আঘাতে ভাঙতে শুরু করে একের পর এক নারকেল। অনেকের মতে, তখন থেকেই মাথার আঘাতে নারকেল ভাঙার প্রচলনটি শুরু হয়। এই লোকাচারের কারণে অনেকসময়ই ঘটে অনেক দুর্ঘটনা। নারকেলের আঘাতে প্রায় প্রতিবছই রক্তাক্ত হন অনেকে। অনেকে চিকিৎসার জন্য তখনই ছোটেন হাসপাতালে, অনেকে আবার মহাদেবকে অধিক তুষ্ট করার আশায় ক্ষতস্থানে মন্দিরে থাকা হলুদের প্রলেপ দিয়েই কাজ চালান।