দেবব্রত মণ্ডল: সময়টা ২০০৬ সাল। রাজ্যে চলছে বিধানসভা ভোট। রাজ্য – রাজনীতিতে সেই সময় বামফ্রন্টের স্বর্ণযুগ, বিরোধী দলগুলোর টিকি খুঁজে পাওয়া ভার। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শহর কলকাতা, লাল পতাকাই একমাত্র বিকল্প। প্রত্যাশা মতোই ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ২৩০টি আসনে জিতে ক্ষমতায় আসে বাম সরকার। এরপর মাত্র কিছুদিনের অপেক্ষা, বামফ্রন্ট সরকার সিদ্ধান্ত নেয় সিঙ্গুরে টাটার ন্যানো কারখানার জন্য জমি অধিগ্রহণ করার। সেই সময় রাজ্যের অনেকেই বোধহয় একটু চোখ কুঁচকেছিলেন। মেহনতি মানুষের স্বপ্ন সত্যি করার শপথ নিয়ে যে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এল তারাই কিনা ন্যানো কারখানার জন্য দু – ফসলি, তিন ফসলি জমি অধিগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিল? কেন গোটা রাজ্যে আর জমি ছিল না? তাদের হিসেবটা ঠিক মিলছিল না। অবশ্য একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে বাম সরকারের এই সিদ্ধান্ত মোটেই অবাক করার মত নয়। কারণ তার কিছুদিন আগে থেকেই বুদ্ধবাবুর মুখে শোনা যাচ্ছিল কর্পোরেট স্ট্রাকচারের ভূয়সী প্রশংসা। তৎকালীন সময়ে গোটা বিশ্বে যেভাবে পুঁজিবাদীরা তাদের প্রভাব বিস্তার করছিলেন তাকে অস্বীকার করতে পারেননি তিনি। তার উপর এই সিদ্ধান্তের কিছুদিন আগেই রাজারহাটে জমি অধিগ্রহণ করতে সফল হয়েছিল বাম সরকার, যা তাদের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল। এর পরের ঘটনা সবারই জানা, পরবর্তী সময়ে সিপিএম সেই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের মাশুল চুকিয়েছিল।
ন্যানো কারখানার জন্য জমি অধিগ্রহণ এবং পরবর্তী সময়ে নন্দীগ্রামে কেমিক্যাল হাব তৈরির জন্য জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত কতটা সঠিক ছিল সেই নিয়ে বিতর্ক চলতেই থাকবে। তবে একথা অস্বীকারের উপায় নেই এই দুই ঘটনা বাম সরকারের ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পথকে আরও ত্বরান্বিত করেছিল। বিরোধী দলনেত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই সুযোগকে হাতছাড়া করেননি। তার হাত ধরেই পশ্চিমবঙ্গ তথা গোটা ভারতের ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছিল সিঙ্গুর – নন্দীগ্রাম আন্দোলন। যদিও এই আন্দোলনের ক্ষেত্রে রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকাকে এখনও অগ্রাহ্য করে নকশালপন্থী সংগঠনগুলি। তাদের বক্তব্য খুব পরিষ্কার, সেই সময় সিঙ্গুর অথবা নন্দীগ্রামের আন্দোলনরত মানুষের পাশে নকশালপন্থী বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে ছাত্র সংগঠনগুলি হাত মিলিয়েছিল বলেই নন্দীগ্রাম – সিঙ্গুরের মানুষরা তাদের হকের দাবি ছিনিয়ে নিতে পেরেছিল। সিঙ্গুর – নন্দীগ্রাম আন্দোলনের পর কেটে গেছে বহুদিন। রাজ্যে ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূল। নন্দীগ্রাম বর্তমানে তমলুক লোকসভার অন্তর্গত। এবারের লোকসভা ভোটে আলাদাভাবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের নজরে ছিল তমলুক। কারণ এই কেন্দ্রের তিন হেভিওয়েট প্রার্থী। সিপিএম, তৃণমূল এবং বিজেপি তমলুক লোকসভা কেন্দ্র থেকে প্রার্থী করেছিল যথাক্রমে সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবাংশু ভট্টাচার্য এবং অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে। ভোটের সারাদিন প্রতিটি বুথে চরকির মতো পাক খেয়ে বেড়িয়েছেন সিপিএমের তরুণ তুর্কী সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায়। অনেক চেষ্টার পর ফোনে ধরা গেল তাকে। লোকসভা ভোটে এবার কেমন ফলাফল আশা করছেন সায়ন? দেবাংশু আর অভিজিৎকে প্রার্থী হিসেবে কত নম্বর দিলেন তিনি? তৃণমূল জমানার সমস্ত ওবিসি সার্টিফিকেট বাতিল করেছে হাইকোর্ট, সেই নিয়েই বা কী মতামত তার? চলুন দেখে নেওয়া যাক লোকসভা ভোটের লড়াইয়ের ফল নিয়ে সায়ন কতটা আশাবাদী।
প্রশ্ন : এবার সিপিএমের তরুণ মুখের মধ্যে আপনি অন্যতম। প্রচারের ক্ষেত্রে কেমন জনসমর্থন মিলেছে? তমলুক লোকসভার ক্ষেত্রে মূল ইস্যু কোনগুলি?
সায়ন : জনসমর্থন নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। মিটিং, মিছিল, জনসভা সবক্ষেত্রেই প্রচুর মানুষের ভিড় ছিল দেখবার মত। বহু মানুষের আশীর্বাদ পেয়েছি, যারা চাইছেন তৃণমূল সরকারের অবসান। আর মূল ইস্যু বলতে ছিল বেকারত্ব, সঙ্গে তমলুক লোকসভা কেন্দ্রে শিল্পের সম্প্রসারণ। দীর্ঘদিন ধরে তমলুকে নতুন শিল্প নেই। নতুন শিল্প এলে তবেই কর্মসংস্থান বাড়বে।
প্রশ্ন : আপনার বিপক্ষে ছিলেন দুই হেভিওয়েট প্রার্থী। তৃণমূলের দেবাংশু, তিনিও ছাত্র রাজনীতি করেই উঠে এসেছেন। অন্যদিকে বিজেপির অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। লড়াই কতটা কঠিন ছিল?
সায়ন : প্রথমত দেবাংশু কবে ছাত্র রাজনীতি করেছে আমার জানা নেই। দ্বিতীয়ত, আমার লড়াই দেবাংশু বা অভিজিতের বিরুদ্ধে ছিল না। আমার লড়াই ছিল শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে, তার নীতির বিরুদ্ধে। আর ভোটের লড়াই সবসময় কঠিন। কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমি ছেড়ে দিতে চান না।
প্রশ্ন : অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় চাকরিপ্রার্থীদের কাছে একসময় ছিলেন ভগবান। বিচারকের আসন থেকে পদত্যাগ করে নির্দিষ্ট একটি রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হয়েছেন তিনি। তার এই সিদ্ধান্ত কি মানুষের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে? সেক্ষেত্রে আপনার লড়াই কিছুটা হলেও কী সহজ ছিল?
সায়ন: দেখুন বিচারক হিসেবে তার রায় নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। আর তার সঙ্গে আমার যে লড়াইটা হল সেটা মতাদর্শগত। আমি রাজনৈতিকভাবেই সেই লড়াইটা লড়েছি। মানুষের মূল সমস্যাগুলোকে আমি তুলে ধরেছি। মানুষ বুঝছে বিজেপি যেভাবে ধর্মীয় মেরুকরণের ভিত্তিতে রাজনীতি করছে তাতে আখেরে ক্ষতি সাধারণ মানুষেরই। তাই তারা আমাদের সাথে আসছে।
প্রশ্ন: কয়েকদিন আগে কলকাতা হাইকোর্ট ২০১০ সালের পর তৈরি হওয়া ওবিসি সার্টিফিকেট বাতিল বলে ঘোষণা করেছে। অন্যদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘বিজেপির এই রায় তিনি মানেন না।’ কী বলবেন? যাদের সার্টিফিকেট বাতিল হল তারা তো অথৈ জলে পড়লেন। একজন আইনজীবী হিসেবে তাদের জন্য কী পরামর্শ দেবেন?
সায়ন : কলকাতা হাইকোর্ট তাদের রায়ে জানিয়ে দিয়েছে নির্দিষ্ট নিয়ম না মানায় সার্টিফিকেট বাতিল হয়েছে। আদালতের রায় সবাই মানতে বাধ্য। এই যে এত মানুষ আজ অসুবিধায় পড়লেন তার দায় কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তার সরকার এড়াতে পারে না। আর আদালত তার রায়ে যা জানানোর জানিয়েছে, এরপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কী বললেন না বললেন তার গুরুত্ব নেই।
প্রশ্ন : দিন কয়েক আগে প্রথমে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এবং পরে হিরণ চট্টোপাধ্যায়ের আপ্ত সহায়কের বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালিয়েছে। কী বলবেন একদিকে বিজেপির অস্ত্র যখন ইডি, সিবিআই অন্যদিকে তৃণমূলের অস্ত্র পুলিশ? বিরোধীদের গলা চেপে ধরা হচ্ছে?
সায়ন : দেখুন বিরোধীদের কন্ঠরোধ করতে তৃণমূল – বিজেপি দুজনেই সমান পারদর্শী। কিন্তু পাশাপাশি একটা কথা মনে রাখতে হবে ইডি-সিবিআই তদন্ত করছে আদালতের নির্দেশে। রাজ্য পুলিশের উপর এমন কোন নির্দেশ নেই।
প্রশ্ন : আপনারা বারংবার তৃণমূলের সন্ত্রাসের কথা বলেন। কিন্তু আপনারা যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন তো সাইবাড়ি দেখেছি আমরা। মেদিনীপুর সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্ধার হয়েছে একের পর এক কঙ্কাল। যার সঙ্গে নাম জড়িয়েছে সিপিএম নেতাদের। সেসব ঘটনা তো মানুষ ভোলেননি। তাহলে তারা কীভাবে আপনাদের ভরসা করবেন?
সায়ন: আপনি যেসব ঘটনা বলছেন তার সবগুলো যে প্রমাণিত এমন নয়। আমরা মানুষের রুটি – রুজির কথা বলছি, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির কথা বলছি। তাহলে আপনার কেন মনে হচ্ছে মানুষ আমাদের নির্বাচিত করবেন না? যদি তর্কের খাতিরে ধরে নিই বাম সরকার বেশকিছু খারাপ কাজ করেছে, সেই কারণেই তো বামদের হটিয়ে মানুষ তৃণমূলকে এনেছিল। আমার প্রশ্ন এখানেই তৃণমূল শাসনে সাধারণ মানুষ কী আদৌ ভালো আছে? এই প্রশ্নটা মানুষ নিজেদের করুন। বাকিটা তাদের হাতে।
প্রশ্ন : আপনি ছাত্র রাজনীতি করে উঠে এসেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পর কলেজগুলোতে ইলেকশন বন্ধ করে দেওয়া হল। কলেজ স্ট্রিট, যে অঞ্চল পরিচিত ছাত্র – রাজনীতির পীঠস্থান হিসেবে সেই কলেজ স্ট্রীটে জারি হল ১৪৪ ধারা। কী বলবেন? তৃণমূল সরকারের এই সিদ্ধান্তের কারণ কী? অন্যদিকে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায় প্রেসিডেন্সি এবং যাদবপুরে ছাড়া বাম রাজনীতি ছাত্রদের মধ্যে খুব একটা প্রভাব ফেলেনি। এটা তো আপনাদের সীমাবদ্ধতা।
সায়ন : এই রাজ্য সরকার তো আদালতের নির্দেশ মানে না। আদালত অনেক আগেই রায় দিয়েছে প্রতিটা কলেজে ভোট করানোর। কিন্তু রাজ্য সরকার মানেনি। কলেজে কলেজে ইউনিয়ন নেই, অথচ ইউনিয়নের নামে টাকা উঠছে। নয়ছয় হচ্ছে টাকা। আর বামপন্থী রাজনীতি যদি ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে প্রভাব না ফেলে তাহলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভোট করাতে ভয় কিসের?
শনিবার ষষ্ঠ দফায় শেষ হল তমলুক লোকসভার ভোট। তমলুকের মানুষ নির্ধারণ করলেন দেবাংশু, সায়ন, অভিজিতের ভাগ্য। সায়ন কী পারবেন নন্দীগ্রাম – সিঙ্গুরের ক্ষতে প্রলেপ লাগাতে? খেলা ঘুরবে এবার? রাজ্য – রাজনীতির মসনদ থেকে একদিন এই নন্দীগ্রাম ছুটি করে দিয়েছিল বামেদের। আজ এতগুলো দিন পরে কী সায়ন ফিরে আসবেন সেই নন্দীগ্রামের হাত ধরে? ভোটের ময়দানে সারাদিন খবরে ছিলেন অভিজিৎ আর দেবাংশু। সায়নকে সেভাবে দেখা যায়নি। নন্দীগ্রাম কী ভুলতে পারবে সেদিনের সেই রক্তাক্ত স্মৃতি? যে দিনটা কেড়ে নিয়েছিল ১৪ টা মানুষের প্রাণ? উত্তর মিলবে ৪ই জুন।